রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের এক সনাতন ধর্মাবলম্বী কিশোরকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নবী মুহাম্মদ–কে কটূক্তি করার অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে ভয়াবহ সহিংসতা। এই একক অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুই দিনে কমপক্ষে ১৫টি হিন্দু বসতঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরও এলাকাজুড়ে রয়ে গেছে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা।
অভিযোগ ও গ্রেপ্তার:
শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, বিকেলে এক সনাতন কিশোর (বয়স ১৭), যিনি স্থানীয় একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, কিশোরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নবী মুহাম্মদ–কে নিয়ে অবমাননাকর লেখা ও ছবি পোস্ট করা হয়েছিল।
ওসি আল এমরান জানান, অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। পরদিন রোববার, সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা দায়ের করে কিশোরকে আদালতের মাধ্যমে রংপুর সম্মিলিত শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
উত্তেজনার সূত্রপাত ও দফায় দফায় হামলা:
কিশোরকে আটক করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শনিবার রাতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত ৯টার দিকে স্থানীয় মিছিলকারীরা কিশোরের বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে প্রথমবার হামলা চালায়। এরপর রাত সাড়ে ১০টায় দ্বিতীয় দফায় আরেকটি মিছিল এসে কিশোরের দাদার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কিশোরের পরিবারের সদস্যরা জানান, পুলিশ ও সেনাবাহিনী তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এলাকায় পুলিশের টহল ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
রবিবারের সহিংসতা: পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ
২৭ জুলাই, রোববার জোহরের নামাজের পর আবারও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, হাজার হাজার লোক জড়ো হবে—এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়।
দুপুর ১টা থেকে পুলিশ মোতায়েন থাকলেও বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে খিলালগঞ্জ বাজার থেকে আসা একদল মিছিলকারী ওই কিশোরের গ্রামে পৌঁছে হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে হামলা চালায়। পুলিশের বাধা দেওয়ার চেষ্টায় সংঘর্ষ বাধে, এতে একজন কনস্টেবল গুরুতর আহত হন এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সেনাবাহিনী এসে ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সরেজমিনে দেখা যায়, আলদাতপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এর আশপাশের এলাকা ছিল সেনা-পুলিশে ঘেরা।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও আতঙ্কের চিত্র:
রোববার রাত ও সোমবার সকালজুড়ে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করেছে। প্রায় ৫০টি পরিবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সোমবার সকালে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ধান, আসবাবপত্র, এমনকি কাঁথা-তোশকও ভ্যানে করে সরিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ তাদের মালামাল বিক্রি করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীদের হাতে দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ছিল। পুলিশের উপস্থিতিতে বাধা দেওয়া হলে পুলিশ সদস্যদেরও লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। পরে পুলিশের পিছু হটার পর হামলাকারীরা একে একে প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।
ক্ষতির বিবরণ:
স্থানীয় ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র রায় ও অন্যান্য সূত্রের মতে, আক্রান্ত ঘরের সংখ্যা অন্তত ১৫টি। যাঁদের বাড়িতে ক্ষতি হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—ধরনী কান্ত মোহন্ত, ধনঞ্জয় কুমার, অতুল চন্দ্র, কমলা কান্ত ও দুলাল চন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথ রায় নামের এক ব্যক্তি জানান, তাঁর স্ত্রীর এক ভরি স্বর্ণ, জমির দলিল এবং প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় লুট হয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী রোহেলা রানী বলেন, “যদি আবার আগুন দেয়, তবে আর কিছু থাকবে না।”
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কালী রঞ্জন রায় জানান, বিদ্যালয়ের ৯৫% শিক্ষার্থী সনাতন ধর্মাবলম্বী। হামলার ভয়ে কোনো শিক্ষার্থী আসেনি।
প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া:
ঘটনার পর রোববার সন্ধ্যায় খিলালগঞ্জ বাজারে উত্তেজিত জনতার সঙ্গে কথা বলতে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা। তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে। আমরা পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করছি।”
রংপুরের পুলিশ সুপার আবু সাইম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ইউএনও জানান, হামলার সঙ্গে কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের লোকজন জড়িত থাকতে পারে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি পরিবারের তালিকা করা হয়েছে এবং তাঁদের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়ে কাজ চলছে।
তদন্ত ও মামলা:
এত বড় ঘটনা সত্ত্বেও সোমবার পর্যন্ত কোনো হামলাকারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি এবং কাউকে আটক করা হয়নি। ওসি আল এমরান জানান, ঘটনার বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং এখনো পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
স্থানীয়দের প্রশ্ন ও উদ্বেগ:
ঘটনার বিষয়ে এক তরুণী বলেন, “আমার কথা, আমরা চাই, যে দোষ করেছে, তাকে শাস্তির আওতায় আনা হোক। আমাদের নির্দোষ মানুষদের ঘরবাড়ি কেন ভাঙা হলো, লুটপাট কেন করা হলো?”
স্থানীয়রা মনে করছেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো একটি সনাতন পল্লির ওপর যেভাবে গণহামলা চালানো হয়েছে, তা স্পষ্টতই পরিকল্পিত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উদাহরণ।
তারিখ: ২৮ জুলাই, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: prothomalo, banglatribune, ajkerpatrika, dailyjanakantha, itvbd, prothomalo
Click here to read this article in English