ইসলামের উত্থানের হাজার আগে থেকেই সৌদি আরবে খুব সমৃদ্ধশালী ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করছিল। আরব উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলে মরুভূমির বৈরি পরিবেশে মরুদ্যান বানিয়ে তায়মা, খায়বার এবং উথ্রিবে ইহুদি সম্প্রদায়ের তিনটি গোত্র বাস করত। নবী মুহম্মদ উথ্রিব দখল করে নতুন নাম দেন মদিনা। ( মদিনাতুল আল মনোয়ারা যার বাংলা অর্থ মুহম্মদের দ্বারা আলোকিত নগরী, সংক্ষেপে মদিনা)। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যবিদ্যার অধ্যাপক এবং আরবি ভাষা, ইসলাম এবং ইসলামের সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ড. মাজুজ হাগাই লিখেছেন, “আরব পেনিনসুলারের উত্তরাঞ্চলে ইহুদি সম্প্রদায়ের ইতিহাসে সবথেকে প্রাচীন এবং ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ সেখানে বসবাস করত। তারা অর্থবিত্তে এবং ক্ষমতায় শক্তিশালী ছিল। তাদের উন্নত সংস্কৃতি, জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য এবং উদার ধর্মের কারনে অন্যান্য অইহুদি আরব গোত্রের মাঝে ইহুদিরা ছিল সম্মানিত। তারা পাহাড়ের উপরে দুর্গ তৈরি করেছিল এবং উন্নত কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তারা সামরিকভাবে দক্ষ ছিল, ছিল নিজস্ব ঘোড়সাওয়ার বাহিনী এবং আধুনিক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এত উন্নত একটা জাতি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আরবে নিজ ভূমি থেকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তার আদ্যপান্ত পড়লে যে কোন রক্তমাংসের মানুষের শরীর আতংকে শিউরে উঠবে”।
মদিনার ইহুদিরা তিনটি গোত্রে বিভক্ত ছিল। বনি কায়নুকা গোত্রের ইহুদিরা ছিল কর্মকার শ্রেণির, তারা লোহার অস্ত্র তৈরি করত, তারা স্বর্ণের অলংকার তৈরিতে পারদর্শী ছিল। বনি নাদির গোত্রের ইহুদিরা ছিল কৃষিজীবি। খেজুর উৎপাদন ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। আর বনি কুরায়জা গোত্রের ইহুদিরা ছিল মদ্য প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী। এই তিন গোত্রের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকত। কখনো কখনো বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছাত যে সত্যি সত্যি যুদ্ধে রূপ নিত।
মুহম্মদ যখন ৬২২ সালে মক্কা থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে মদিনাতে আশ্রয় নিলেন তখন সর্ব প্রথম তাকে আশ্রয় দিয়েছিল একজন ইহুদি। ক্রমে ক্রমে তিনি ইহুদিদের সাথে মিত্রতা গড়ে তুললেন। কিন্ত দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও যখন দেখা গেল মুহম্মদ একজন ইহুদিকেও তার প্রচারিত নতুন ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারলেন না এবং কেউ তাকে নবী হিসেবে স্বীকৃতিও দিল না তখন আশ্রয়দাতার সাথে প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু হয়ে গেল। তিনি তার অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন কৃষিজীবী ইহুদি বনি নাদির গোত্র প্রধান এবং তখনকার জনপ্রিয় কবি কা’ব ইবনে আল-আশরাফকে খুন করে তার মাথা কেটে নিয়ে আসতে। শুধু তাই নয়, নবী মুহম্মদ আদেশ দিলেন পারলে সব ইহুদিকে হত্যা করো। নবী প্রথমে বনি কায়নুকা গোত্রকে অবরোধ করলেন কারন তিনি জানতেন আত্মকলহে ব্যস্ত ইহুদি গোত্র কেউ কারো সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। বনি কায়নুকা গোত্রের ইহুদিরা যুদ্ধে পারদর্শী হলেও অবরোধের কারনে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তীব্র খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দিলো। ফলে বনি কায়নুকা গোত্র মুহম্মদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।
গল্পপাঠ এখানেই থামিয়ে দিই। আমি যদি কোন হলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্য পড়ি এবং তার কাহিনী এগিয়ে যায় এভাবে যে, সিনেমার মূল চরিত্র মুহম্মদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন পারলে সব ইহুদিকে হত্যা করো, এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল একজন ইহুদি গোত্রপ্রধানের শিরোশ্ছেদের মাধ্যমে তাহলে আমি বলতাম গল্পটা অবাস্তব এবং ফালতু। কিন্তু এটা কোন সিনেমার কল্প গল্প নয় বরং হুবহু প্রিয় নবীর জীবন থেকে নেয়া।
ইহুদি গোত্রের মাঝে ঐক্য কি এতই তিক্ত ওষুধ যে তাদেরকে সায়ানাইড গিলে আত্মহত্যা করতে হলো? মুহম্মদের সামরিক শক্তি নিশ্চয়ই তিনটি ইহুদি গোত্রের মিলিত শক্তির থেকে বেশি ছিল না। কেন কৃষিজীবী আর ব্যবসায়ী ইহুদি দুইগোত্র মিলিত হয়ে অবরোধ ভেঙে কর্মকার ইহুদিদের বাঁচাতে এগিয়ে আসলো না? কিভাবে তারা তাদের স্বধর্মের মানুষ হত্যার সময়ে চুপচাপ বসে ছিল? যদি আত্মকলহের কারনে পরস্পরকে ঘৃণা করেও থাকে তবু নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে এবং মুহম্মদের শান্তিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে নিশ্চিতভাবেই তাদের উচিত ছিল ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা। আপদকালে বিবাদ ভুলে যাওয়াই নিয়ম, শাস্ত্রে আছে। সিনেমায় যেটা অবাস্তব আর নির্বোধ মনে হয়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাস্তবে তাই ঘটে। আপনি হয়ত জানেন না এবং বাস্তবে মেনে নিতেও পারেন না, সেই ইহুদি গোত্রপ্রধান কবিকে হত্যা করেছিল নাবালক দুই শিশু।
সত্যি সত্যি অন্য দুই ইহুদিগোত্র আক্রান্ত কর্মকার ইহুদি গোত্রকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো না। কর্মকার গোত্রটি মুহম্মদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করল। নবী মুহম্মদ চেয়েছিলেন পরাজিত সব ইহুদিকে একবারে জবাই করে দিতে কিন্তু মিত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবায় নবীকে অনুরোধ করে এই গণহত্যা বন্ধ করেন তার পরিবর্তে পরাজিত ইহুদিদেরকে বলা হয় মদিনার বাসভূমি, তাদের সম্পদ, গবাদি রেখে চিরতরে জর্ডানে নির্বাসনে চলে যেতে।
আমাদের প্রিয় নবী মুহম্মদ পরাজিত ইহুদিদের রেখে যাওয়া সমুদয় মুল্যবান সম্পত্তি গনিমতের মাল হিসেবে দখল করে নিলেন। দখলকৃত ইহুদি সম্পদে শক্তিশালী হয়ে একবছরের মধ্যেই নবী মুহম্মদ কৃষিজীবী ইহুদি গোত্রের দিকে নজর দিলেন। কি অমিত প্রতিভাধর রাজনীতিবিদ আমাদের প্রিয় নবী। ব্যবসায়ী ইহুদি গোত্র যাতে কৃষিজীবী গোত্রকে বাঁচাতে এগিয়ে না আসে তার জন্য ব্যবসায়ী গোত্রের সাথে আগে থেকেই মিত্রতা গড়ে তুললেন।
এটা পাগলামি, আমার সিনেমা সমালোচক মন এত পূর্ব পরিকল্পনা মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারে নি মানুষ হত্যার নীল নকশা। হতে পারে মদ্য ব্যবসায়ী ইহুদিরা নিজেদের গুদামের সমস্ত মদ্য নিজেরাই আকণ্ঠ গিলে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করার জন্য মুহম্মদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল। ইহুদি গোত্রের মাঝে ঐক্য কি এতই তিক্ত ওষুধ যে তাদেরকে সায়ানাইড গিলে আত্মহত্যা করতে হলো?
নবী মুহম্মদের শান্তিবাহিনী ৬২৫ সালে খেজুরচাষী ইহুদি বনি নাদির গোত্রকে অবরোধ করলেন। ফলাফল আগের মতই, অবরোধের কারনে তারা নিঃশেষ হয়ে গেল এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হলো। এবারেও নবী মুহম্মদ চেয়েছিলেন সব ইহুদিকে নিকেশ করে দিতে। কিন্তু বাদ সাধলেন সেই আবদুল্লাহ ইবনে উবায়। জবাই হওয়া থেকে নির্বাসন উত্তম। প্রাণের দায়ে খেজুরচাষী ইহুদি বনি নাদির গোত্র খায়বারে চলে গেল। মুসলিম ইতিহাসবিদের লেখা থেকেই পাওয়া যায় সমৃদ্ধশালী খায়বারে তখন ছিল ইহুদি ধর্মের পুরোহিতদের আদি নিবাস।
তিন বছরের মাথায় মুহম্মদ আরবের উত্তরাঞ্চলের সমৃদ্ধশালী শহর খায়বার দখল করে নেন। মুসলিমরা তখনো কৃষি কাজ জানত না। আর এখানে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায় কৃষিকাজে খুবই দক্ষ ছিল। তাই মুহম্মদ এখানের কৃষিজীবী ইহুদিদের হত্যা না করে ‘ধিম্মি’ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখলেন। ধিম্মি হলো নবী মুহম্মদ ঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক যাদেরকে ধর্ম পালনের জন্য সরকারকে অতিরিক্ত কর দিতে হতো। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা খায়বার থেকে সব ইহুদিকে বহিষ্কার করে দেন কারণ নবী মুহম্মদের নীতি অনুসারে আরবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম পালন করা যাবে না।
আসুন, মদিনায় ফিরে আসি। অবশিষ্ট মদ্য ব্যবসায়ী বনি কুরায়জা ইহুদিগোত্রটি মাত্র দুইবছর টিকে ছিল। ৬২৭ সালে মুহম্মদ ৩০০০ সৈন্য নিয়ে তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। এদিকে ইহুদিদের ছিল মাত্র ৫০০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধা। ততদিনে মরে গেছে আবদুল্লাহ ইবনে উবায়। ইহুদিরা জানত এবার তাদের শিরোশ্ছেদ ঠেকাতে কেউ এগিয়ে আসবে না। অবরুদ্ধ ইহুদি নেতা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল কি করা যায়। কয়েকটা পন্থা আছে, হয় ইসলাম কবুল করা অথবা মাসাদা (অপমান এবং দাসত্ব থেকে বাঁচতে গোত্রের সব নারী ও শিশুদের হত্যা করে পুরুষরা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে বীরের মত মরে যাওয়া) করা।বনি কুরায়জা গোত্রের নেতারা মুহম্মদের কাছে দুইটা বিকল্প বাদ দিয়ে আত্মসমর্পণ করে মদিনা ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তাব দিল।
মুহম্মদ ইহুদিদের এই প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। গত দুইবার যখন দুইটা গোত্র মুহম্মদের অন্যায় অবরোধের কবলে পড়েছিল এবং এই মদ্য ব্যবসায়ী বনি কুরায়জা ইহুদিগোত্রটি তাদেরকে সাহায্য করতে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এবার সেই গোত্রটির ভাগ্যে কি নির্মম পরিণতি ঘটে সেটা শুনলে শিউরে উঠবেন। শান্তিবাহিনী শিশুদেরকে হাটে বাজারে গবাদিপশুর মত বেচে দেয়, নারীদেরকে বিজয়ী সৈন্যদের মাঝে বন্টন করে দেয়া হয় এবং পুরুষদেরকে প্রকাশ্যদিবালোকে বাজারে জবাই করা হয়। মুসলিম লেখকদের লেখা থেকে জানা যায় সেদিন ইহুদিরক্তে বাজার ভেসে গিয়েছিল।
মুহম্মদ আর আল্লাহর চক্রান্তে বিশাল শক্তিশালী সমৃদ্ধ ইহুদি সম্প্রদায় মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আসলে কি মুহম্মদের দ্বারা ইহুদি সম্প্রদায় ধ্বংস হয়ে গেল নাকি ইহুদিদের বিভাজন তাদের ধ্বংস করে দিল? এটাই হলো মদিনার ইহুদি নিশ্চিহ্নকরণ সিনেমার বিয়োগান্তক সমাপ্তি। অতঃপর আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ কর্তৃক একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করা, বিশ্বাসঘাতকতা আর গণহত্যার সিনেম্যাটিক ইতিহাস। নবী মুহম্মদ কোন ধরণের উস্কানি ছাড়াই মদিনাতে বসবাসকারী ২০০০ বছরের পুরনো জাতিগোষ্ঠীকে হামলা চালিয়ে, হত্যা করে, ধর্মান্তর করে, তাদের সম্পত্তি দখল করে, তাদের নারীদের যৌনদাসী বানিয়ে, শিশুদের দাস বানিয়ে, দেশছাড়া করে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রিয় নবী মুহম্মদের আসল উদ্দেশ্য ছিল যেকোন উপায়ে ইহুদিদের সম্পত্তি দখল করা, যৌনতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন।
মুহম্মদের আক্রমণে মদিনার ইহুদিদের ভাগ্যে প্রকৃতপক্ষে ঠিক কি ঘটেছিল তার পুরোপুরি সঠিক তথ্য বোধহয় কোনদিন জানতে পারব না। কারন ইসলামের প্রচার কাজে কত সংখ্যক ইহুদি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য সূত্র নেই। তথ্য দেয়ার জন্যেও মুহম্মদ কেউকে বাঁচিয়ে রাখেন নি। আর কে না জানে মৃত মানুষ ইতিহাস লিখতে পারে না। আমাদের হাতে আছে শুধু মুসলিম ইতিহাসবিদদের লেখা ইতিহাস যেটা অবশ্যই মুহম্মদের উপর আনুগত্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রেখে লেখা। সেখানে প্রতিটা বাক্যে ইহুদি বিদ্বেষ স্পষ্ট। তারই ফাঁকফোঁকর দিয়ে কিছু সত্য বেরিয়ে পড়ে আর সেখানে আমরা দেখতে পাই ইহুদির ভাগ্যলিখন।
কিছু মুসলিম লেখক হয়ত অনুশোচনায় তখনকার মদিনায় বসবাসকারী ইহুদিদের সংখ্যা এবং তাদের গুরুত্ব কমিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন। ডঃ আবদুল জহুর এবং ডঃ জেড হক লিখেছেন, ইহুদিরা ঠিক কখন থেকে কত সংখ্যায় উথ্রিবে বসবাস শুরু করেছে সে সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। আর এতদিন বসবাস করার পরেও ইহুদি জনগোষ্ঠী সংখ্যায় খুব বেশি বাড়ে নি। মুসলিম স্কলারদের লেখায় ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য তথ্য খোঁজার প্রচেষ্টা না থাকলেও তাদের বাক্যের ছত্রে ছত্রে কিঞ্চিত উঁকি মেরে যায় সত্যি ইসলামের প্রচার মুহূর্তে ইহুদিদের ভাগ্যে কেমন ব্যবহার জুটেছিল। মওদুদি তার কিতাব আল-আঘানি Kitab al-Aghani, [a book of songs, an important source for information on medieval Islamic society, vol. xix, p. 94, by Abu al-Faraj Ali of Esfahan (897-967)] গ্রন্থে লিখেছেন
হেজাজে ইহুদি পুনরবাসনঃ হেজাজের ইহুইরা দাবি করে তারা নবী মুসার জীবদ্দশার শেষ দিকে সৌদি আরবে এসে বসবাস শুরু করে। ইহুদিরা প্রচার করে নবী মুসা উথ্রিব থেকে আমালেকিটদের তাড়ানোর জন্যে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন এবং আদেশ দেন ঐ গোত্রের যেন একজনও সেখানে না থাকতে পারে। ইজরায়েলের সেনাবাহিনী নবী মুসার আদেশানুসারে আমালেকিট গোত্রের সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। তবু একজন সুদর্শন যুবরাজ কিভাবে যেন তাদের সাথে ফিলিস্তিন পর্যন্ত চলে আসে। এরমধ্যেই নবী মুসা দুনিয়া ত্যাগ করে মুসা তার স্রষ্টা জেহোভার কাছে চলে গেছেন। আমালেকিট গোত্রের একজনকেও জায়গা দেয়ার মানে হলো মুসার আদেশ অমান্য করা, মুসার আইনের পরিপন্থী। তাই নবী মুসার উত্তরাধিকারীগণ সেনাবাহিনির উপর মহা ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে ইহুদি সম্প্রদায় থেকে চিরতরে সেনাবাহিনী বাদ দিয়ে উথ্রিবে ফিরে এলো এবং তখন থেকে তারা সেখানেই বসবাস করছিল। এই কারণেই ইহুদিরা প্রচার করে যে তারা যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও ১২০০ বছর আগে থেকে এখানে বসবাস করছে। যখন ব্যবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার ইহুদি বাসভূমি জেরুজালেম ধ্বংস করে দিলেন তখন এই অঞ্চলে ইহুদিদের দ্বিতীয়দফা আগমণ ঘটে। সেটাও যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৫৮৭ আগের ঘটনা। তখন ইহুদিরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আরব্য ইহুদিদের ভাষ্য অনুযায়ী আরবের কয়েকটি অঞ্চল যেমন ওয়াদি আল-কুরা, তায়মা, উথ্রিবে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। .(Al-Baladhuri, Futuh al-Buldan).”
মওদুদি ইতিহাসের দুটি দাবীকে বাতিল করে বলেন, “ইহুদিরা প্রাচীনকাল থেকেই আরবে বাস করছিল এই দাবীর স্বপক্ষে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। নিজেদেরকে নবী মুসার গর্বিত বংশধর পরিচয় দিয়ে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা প্রমাণ করতে ইহুদিরা ইতিহাসের গল্প আবিষ্কার করেছে”। নিন্দুকেরা কখনো শতভাগ মিথ্যা বলতে পারে না। যাইহোক, মওদুদিও পারেন নি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ইহুদি রক্তের দাগ, ৭০ খিস্টাব্দে রোমান বাহিনী ফিলিস্তিনে ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালায়, তারপরে ১৩২ খ্রিস্টাব্দে তাদেরকে সর্বহারা করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হলে তারা হেজাজে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা আবার আবাস শুরু করে, শুরু করে আবাদ। সেচের ব্যবস্থা করে সবুজ ফসলে বৃক্ষে চারিদিক শোভিত করে ফেলে। মওদুদি প্রতিষ্ঠিত সত্য বলতে বাধ্য হয়েছেন কিন্তু ইহুদিদের করুণ ইতিহাসের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন ধর্মের ঘৃণা, একটা জাতিগোষ্ঠীকে হীন করে প্রদর্শন করার চেষ্টা। যেমন ইহুদিরা সেই সময় আরবদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর সুদের ব্যবসা করে উর্বর ভুখণ্ড দখল করে নেয়। আইলা মাকনা, তাবুক, তাইমা, ওয়াদি আল-কুরা, ফাদাক, খায়বার ইত্যাদি সমৃদ্ধ অঞ্চল ইহুদিদের দখলে চলে আসে। সেই সময় বনি কুরায়জা, বনি নাদির, বনি বাহদাল, বনি কায়নুকা গোত্রের ইহুদিরা উথ্রিব দখল করে নেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। যেহেতু মওদুদি ইতিহাসের ধারে কাছে না গিয়েও ইতিহাসের বয়ান দিয়ে দিলেন সেহেতু আমরাও একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি মুহাম্মদের দ্বারা আলোকিত অন্যান্য মুসলমানের মত মওদুদিও উথ্রিবে ইহুদিদের প্রাচীন বসবাস অস্বীকার করতে এবং ইহুদিদের প্রতি ধর্মীয় ঘৃণা প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেই ইতিহাস বানিয়েছেন। মওদুদির নিজের স্বীকারোক্তিতেই দেখা যাচ্ছে এই অঞ্চলের সবুজ উর্বর ফসলি জমির মালিক ছিল ইহুদি। সুতরাং মওদুদির থলের বিড়াল বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে ইহুদিদের জন্য মুসলিমদের সঞ্চিত ঘৃণার জন্ম সেই মুহম্মদের ধর্ম প্রচার থেকে যার যাত্রা শুরু, সেটা মওদুদির মত একজন ইসলামী স্কলারও ঢাকতে পারেন না। ফলে তাকেও মুহম্মদ কর্তৃক ইহুদি জাতিগোষ্ঠী নির্মূল ও দেশত্যাগের নির্মমতা সমর্থন করতে মিথ্যা গল্পের আশ্রয় নিতে হয়। আরবে ইহুদি বসতি ছিল কি ছিল না সেটা মুসলিম ইতিহাসবিদগণের স্বীকার করা বা না করাতে ইতিহাসের কিছু যায় আসে না। ইতিহাস জানে ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে ইহুদিরা কত শত বছর ধরে উথ্রিবে বসবাস করে আসছে কত রক্ত ঝরেছে তাদের শরীর থেকে আর মরেছে কত।
শতাব্দী অতিক্রমে বংশ পরম্পরায় এই অঞ্চলের ইহুদিদের ভাষা হয়ে গেছে আরবি, এমনকি ব্যবহারের অভাবে ভুলে গেছে নিজেদের মাতৃভাষা হিব্রু। হিব্রু আর ইসলাম পূর্ববর্তী আরবি কবিতার ছন্দ, বাক্য প্রকরণ, চিন্তা আর বিষয়বস্তু মিলে যায় কি দারুণ। আর ভাষাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় হিব্রুর পেটের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে আরবি ভাষা। এ অঞ্চলে তাদের পোশাক, সভ্যতা, জীবনযাপনের রীতিনীতি রীতিমত আরবের সাথে মিশে গেছে। এমনকি তাদের নাম পর্যন্ত আরব্য হয়ে গেছে। হেজাজ অঞ্চলে প্রায় বারোটি ইহুদি গোত্র বসবাস শুরু করেছিল এরমধ্যে শুধু বনি জাউরা তাদের হিব্রু নাম ধরে রেখেছিল। স্থানীয় আরবদের সাথে তাদের বিয়ে হয়েছে, রক্ত গেছে মিশে। একমাত্র ইহুদি ধর্ম পরিচয় ছাড়া তাদেরকে আর গড়পরতা আট দশজন আরব থেকে আলাদা করা যায় না। পেট্রো ডলার প্রভাবিত পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদগণ নির্মূল হয়ে যাওয়া ইহুদিদের প্রকৃত ইসরায়েলি নয় বলে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারেন। বাজারে এমন প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়। তারা হয়ত বলতে চান এই অঞ্চলের মানুষ সবাই ইহুদিধর্মে দিক্ষিত হয়েছিল অথবা তারা সবাই ছিল আরব্য ইহুদি। পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদগণও সত্য থেকে বেশি দূরে থাকতে পারেন না। কারন যদি প্রকৃতপক্ষেই ইহুদিরা আরবে অভিবাসী হয়ে আসে তাহলে ২০০০ বছরে তারা সর্বতভাবেই একজন আরবের অধিবাসীতে পরিণত হয়ে গেছে।
মওদুদি বলতে চান, পৃথিবীতে আরব্য ইহুদি বলে কোন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। তারা তাদের ইতিহাস এমন কিছুই লিখে যায় নি যেটা পড়ে আমরা বুঝতে পারব সেই ইহুদিদের অতীত কেমন ছিল, কোথা থেকে তারা আরবে এসেছিল। কোন ইহুদি ইতিহাসবিদ তাদের গ্রন্থের কোন লেখায় আরবের ইহুদিদের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি। এমনও হতে পারে আরব্য উপদ্বীপে বসবাস শুরু তারা মূল ইহুদি সম্প্রদায় থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল অথবা হিব্রু সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে যাওয়া, আরবি ভাষায় কথা বলা, আরব্য নাম ব্যবহার করা, আরব্য সংস্কৃতি গ্রহণ করা ইত্যাদি কারনে মূল ইহুদি সম্প্রদায় আরবের ইহুদিদের নিজেদের ধর্মের অনুসারি বলে স্বীকার করত না। আরব্য ইহুদিদের ইতিহাস নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না এর কারন মৃত মানুষ ইতিহাস লিখতে পারে না, যারা লিখতে পারত নবী মুহম্মদের ইসলামী আগ্রাসনে তারা সবাই খুন হয়ে গেছে।
যদি আরবের ইহুদিরা এতই আরবের সংস্কৃতিতে মিশে গিয়ে থাকে তাহলে কেমন করে তাদেরকে খুন করার জন্য আলাদাভাবে চেনা যেত? যদি মুসলিম ইতিহাসবিদদের লেখা দেখি তাহলে সেখানেও দেখতে পাবো মুহম্মদদের জন্মের ৫০০ বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে ইহুদিরা তাদের ধর্ম নিয়ে বহাল তবিয়তে বসবাস করছিল এবং উথ্রিবকে তাদের নিজেদের বাসভূমি মনে করত। ৫০ এবং ৫১ সালে ইয়েমেনে ভয়ানক বন্যার ফলে বিভিন্ন গোত্রের বিপুল সংখ্যক মানুষ আরবে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে আস এবং খাযরাজ গোত্র উথ্রিবে বসতি গড়ে তোলে। এই দুই গোত্রের মানুষ সংখ্যায় বেশি হলেও তারা বেশিরভাগ ছিল অদক্ষ। তাদের কর্মসংস্থান, অন্ন যোগানের ব্যবস্থা হলো ইহুদিদের গৃহকর্মে আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। কারন আরবের বেশিরভাগ ব্যবসা বাণিজ্য তখন ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ইহুদিরা তাদেরকে নিচু শ্রেণির মনে করত। মুহম্মদের ইসলাম তাদেরকে সাম্যের গান গেয়ে শোনালে তখন তারা দলে দলে যোগ দেয় ইসলামের শান্তির ছায়াতলে এবং প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আসে। এই দুই গোত্র আবার পরস্পরের শত্রু, দুইচোখের বিষ এবং দুই গোত্রই যেকোন ইহুদি গোত্রের সাথে মিশে থাকতে চাইতো। এটা মুহাম্মদের ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে খুব কাজে লেগেছিল। যেহেতু বনি কায়নুকা গোত্রের সাথে অন্য দুইটি ইহুদি গোত্রের সাথে শত্রুতা সেহেতু বনি কায়নুকা খাযরাজের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলল। অন্যদিকে বনি কুরায়জা, বনি আল-নাদির, আর আস মিলেমিশে নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করল। একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ এইযে গোত্রগুলো আন্ত-গোত্র সংঘর্ষের আশু সম্ভাবনায় নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে সেটা কিন্তু ধর্মপ্রচারের জন্য নয় বরং এর পিছনে রয়েছে গোত্রের দ্বন্দ্ব। মওদুদি মন্তব্য করেন, “ইহুদিরা শুধু আরবদের সাথেই যুদ্ধ করত না, অন্য আরবদের সাথে মিত্র ইহুদি গোত্রের সাথেও যুদ্ধ করত”। যদি মুসলিম স্কলারদের চোখে ইতিহাস দেখি তাহলে দেখতে পাবো চোখের উপর ঘন কুয়াশার মত ধর্মের সংস্কার তাদের দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে যেখানে ইহুদি বিরুদ্ধাচার করার কথা বলা আছে। আরবের রুক্ষ মরুভূমিতে গোত্রভিত্তিক লড়াই চিরাচরিত। টিকে থাকার লড়াই পৃথিবীর সর্বত্র। এইসব গোত্রের লোকেরা প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম পালন করছিল।
কিন্তু এই লড়াইয়ের পিছনে কোন ধর্ম ছিল না। গোত্র বিভাজনের যুদ্ধ বেশিদিন স্থায়ী হয় না কিন্তু ধর্মের ঘৃণা চিরস্থায়ী। এই হিংসার কোন বিনাশ নেই, এই বিদ্বেষ থেকে কোন পরিত্রাণ নেই। এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে জনপদে, লোকালয়ে বিধ্বংসী ভাইরাসের মত। ছাড়িয়ে যেতে পারে স্থান ও কালের গণ্ডী। নবী মুহম্মদ হলো সেই মহান ব্যক্তি যিনি ধর্মভিত্তিক ঘৃণার চর্চা উদ্ভাবন করেছেন এবং ছড়িয়ে দিয়েছেন বিষাক্ত গ্যাসের মত, আরব অঞ্চলে ধর্মের নামে মানুষ খুনী শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। এখন মনে হয় সারা পৃথিবীটাই যেন একটা গ্যাস চেম্বার। আরব জাতিগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করার জন্য নবী মুহম্মদকে প্রায়ই কৃতিত্ব দেয়া হয়। কথাটা অনেকটা সত্যি। মুহম্মদকে ছাড়াই গোষ্ঠীগুলো হয়ত আজ অথবা কাল অথবা ও পরে বিবাদ ভুলে গিয়ে মিলে যেত, হয়ত মিত্র গোষ্ঠীর সাথে শত্রুতা বা শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যেত। পৃথিবীর সব এলাকার গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব অনাদিকাল থেকে এভাবেই চলছে। কেউ কারো চিরকালের শত্রু নয়, বন্ধুও নয়।
যেমন ইউরোপের দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৈরিতা ভুলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করেছে। ইউরোপের মানুষ ভিসা ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যাচ্ছে। নবী মুহম্মদ আরব জাতিগোষ্ঠীকে একত্রিত করে শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করেন, রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘুমন্ত ইহুদি জনপদে, বানিজ্য ও তীর্থে আসা উটের কাফেলায়, আক্রমণ করেন দেশে দেশে, ধ্বংস করে দেন সে দেশের সভ্যতা, আর চাপিয়ে দেন নিজের ভাষা, সংস্কৃতি আর তার নিজস্ব ধর্ম যিনি নিজেই সেই ধর্মের প্রচারক। হয় ইসলাম গ্রহণ করো অথবা কতল হয়ে যাও। ইসলাম গ্রহণ করলে এবার দায়িত্ব কায়েম করা। ইসলাম গ্রহণ করার কারনে আরবের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিল। মরুবাসী আরব গোত্রের একতার সুযোগ ব্যয় হলো সারা পৃথিবীব্যপী মানবতার উপর হাজার বছর ধরে হিংসার অগ্নি প্রজ্বলন।
পরবর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখকঃ বিকাশ মজুমদার
মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী
নিউইয়র্ক, ইউএসএ
তারিখ: ১০ আগস্ট, ২০২৫
[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]