প্রথম পর্বের পর……
মদিনায় হিজরত
আরবের বিভিন্ন গোত্র গোষ্ঠী সবসময় পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এরমধ্যে মক্কাবাসীর অবস্থান সবথেকে সুবিধাজনক। আরবের সব গোত্রের পবিত্র স্থান কা’বা মক্কায় অবস্থিত যেখানে আছে তীর্থস্থান, ক্ষমতা এবং বাণিজ্য কেন্দ্র। চাচা আবু তালিব এবং ধনী পত্নী খাদিজা মারা গেলে মক্কায় মুহম্মদের শক্তির ভিত নড়ে যায়। মাথার উপর থেকে সরে যায় নিরাপত্তার চাদর। নতুন প্রচারিত ধর্মের কারনে তার প্রতি মানুষের উপদ্রব বেড়ে যায়। অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি মশকরা করত। নবী মুহম্মদের তখন মনে পড়ে গেল তায়েফের কিছু লোক বলেছিল যদি মুহম্মদের নতুন ধর্ম দিয়ে তাদের শহরকে পবিত্রভূমি এবং বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করে দিতে পারে তবে তায়েফবাসী তাকে সাহায্য করতে পারে।
পালিতপুত্র জায়েদ ইবনে হারিথকে সাথে নিয়ে নবী মুহম্মদ গোপনে তায়েফে চলে গেলেন। তায়েফের গোত্রদের সাথে মৈত্রী গড়তে চাইলেন এবং ঘোষণা দিলেন, হে তায়েফবাসী, তোমরা শোন, তায়েফকে আমি মুসলিমদের জন্য পবিত্র করে দিলাম। বনি তায়েফ গোত্র যেন মুহূর্তেই দেখতে পেল তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম হুমকির মুখে। ফলে বনি তায়েফবাসী নবীর ডাকে সাড়া না দিয়ে তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করতে লাগল। এমনকি গোপন রইল না বনি তায়েফের সাথে রাতের অন্ধকারে মিত্রতার গোপন প্রস্তাব। তায়েফ নেতারা হয়ত মক্কার ধর্মীয় সুবিধাজনক অবস্থানের কারনে কিছুটা হিংসা করে কিন্তু তাই বলে গোত্রের ধর্ম ছেড়ে নতুন অজানা ধর্ম গ্রহণ করার মত ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না। কুরাইশ গোত্র যখন বুঝতে পারল মঞ্চে মুহম্মদ উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে তখন তার প্রতি অত্যাচার, নিপীড়ন বাড়িয়ে দিল।
বছর খানেকের মধ্যে কুরাইশ গোত্র হত্যা মুহম্মদকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। মুহম্মদ খুনের পরিকল্পনা জানতে পেরে সঙ্গীসহ রাতের আঁধারে উথ্রিবে হিজরত করেন। উথ্রিবে খাযরাজ এবং আস গোত্রের কিছু মানুষ আল্লাহ এবং তার প্রেরিত পুরুষ মুহম্মদের উপর ইতিমধ্যেই ঈমান এনেছেন। আর এদিকে উভয় গোত্রই দীর্ঘদিন নিজেদের মাঝে যুদ্ধে লিপ্ত। কয়েকদিন আগেই ঘটে গেছে বু’আতের যুদ্ধ। খাযরাজ এবং আস গোত্র হিংসা বিদ্বেষের বদলে সহাবস্থানের উপায় খুঁজছে আর এমন সময় মুহম্মদ নিয়ে এলেন শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায়। সুতরাং দুই গোত্রই মুহম্মদকে তাদের মধ্যস্ততা করার জন্য মনোনীত করল।
চুক্তি
আরবে নিয়ম ছিল যুদ্ধরত দুইটা গোত্রই তাদের মধ্যকার বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে বিশ্বস্ত যেকেউকে মধ্যস্ততাকারী মনোনীত করতে পারে। মুহম্মদ যেহেতু বাইরে থেকে এসেছে এবং তাদের গোত্রের কেউ নয় তাই সবাই ধরে নিলো মুহম্মদ হয়ত নিরপেক্ষ হবেন। মুহম্মদের সামনে চলে এলো সোনালী সুযোগ যা বদলে দিলো তার নব্যুয়ত জীবন, প্রতিকূল অবস্থা চলে এলো অনুকুলে। অপরিণামদর্শী ইহুদিরা বুঝতে পারেনি কাকে দিয়েছে আশ্রয়। যে আশ্রয়ে থেকেই আশ্রয়দাতাকে ধ্বংস করে দেবেন নিমিষে সমূলে। এই চুক্তি মুসলিমদেরকে শাসনের ভার দেয় না, কিন্তু দায়মুক্তির আয়োজন করে। চুক্তি হচ্ছে দুইটা গোত্রের মাঝে সেখানে মুসলিমরা কোনভাবেই কোন পক্ষ নয়, কিন্তু মুহম্মদ কৌশলে চুক্তির ধারার মধ্যে মুসলিমদেরকে চুক্তির পক্ষ করে দিলেন। ইহুদি এবং মুসলিম উভয়েই নিজ নিজ ধর্ম কোনপ্রকার বাধা ছাড়াই পালন ও প্রচার করতে পারবে। চুক্তিপত্রের যেকোনপক্ষ আক্রান্ত হলে অন্যপক্ষ সাহায্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য থাকবে।
কেউ কারো বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পরস্পর পরামর্শ করবে ও আনুগত্য বজায় রাখবে। একে অপরের সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠবে। এই চুক্তি টিকে থাকবে দ্বিপাক্ষিক বিশ্বাসের উপরে। কেউ ভুল করলে অন্যকেউ তাকে শুধরে দেবে। যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন যুদ্ধের যাবতীয় খরচ দেবে ইহুদিরা। উথ্রিব হবে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সবপক্ষের মানুষের নিরাপদ স্থান। কোন বিবাদ বা সংশয় দেখা দিলে সমাধানের জন্য আল্লাহ এবং তার প্রেরিত পুরুষের উপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কুরাইশগোত্র এবং তাদের সাহায্যকারীরা কখনো সুরক্ষা পাবে না। প্রত্যেকে নিজেদের জান মালের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
চুক্তির কিছু ধারা পড়লে বোঝা যায় চুক্তির মধ্যে মুসলিমরা কৌশলে ঢুকে পড়েছে। চুক্তির অন্যতম দিক হলো, ইহুদিদের এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হলে তাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে যে মুহম্মদ আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। দুইটা অইহুদি গোত্রের মাঝে চুক্তির মধ্যে কেন ইহুদি গোত্রের কথা আসে সেটা বোধগম্য হয় না। চুক্তির কয়েকটি ধারার দিকে আবার একটু চোখ বুলিয়ে নিই, “যুদ্ধ চলবে ততদিন যুদ্ধের যাবতীয় খরচ দেবে ইহুদিরা এবং কোন বিবাদ বা সংশয় দেখা দিলে সমাধানের জন্য আল্লাহ এবং তার প্রেরিত পুরুষের উপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে”। বাক্য দুটি প্রমাণ করে চুক্তির দুই পক্ষের অসাম্য। লক্ষ্য করুন, মুহম্মদ সুবিধাজনক অবস্থানে চলে এসেছেন।
এই চুক্তি মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করছে অথচ মুসলিমরা এই চুক্তির কোন পক্ষই নয়। নিরপেক্ষ মুহম্মদ কিভাবে এই চুক্তির একজন সুবিধাগ্রহনকারী হতে পারে? মজার বিষয় হলো ইসলামী চিন্তাবিদেরা শতক সহস্র বছর ধরে এই চুক্তি নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছেন অথচ প্রশ্ন করতে পারেননি একজন এই চুক্তির একজন সুবিধাগ্রহনকারী কিভাবে মধ্যস্ততাকারী হতে পারে? কিন্ত এটাই হলো আলোচ্য বিষয়। ধার্মিকের মন ধর্মের বেড়াজালে বন্দি। ধর্মের আফিম নেশাগ্রস্থ করে রেখেছে ধার্মিকের অন্ধ চোখ। যদিও তারা অন্য ধর্মের বৈকল্য, বিচ্যুতি, কুসংস্কার দেখলে হাসি, তামাশা এমনকি অপমান করতেও বাধে না। মুহম্মদ এবং তার সদা খুন করতে প্রস্তুত অনুসারীরা মূল চুক্তিকে নষ্ট করে ফেলেছেন। এখন মূল চুক্তির বিষয়বস্তু এবং প্রমাণ ও সত্যতা খুঁজতে যাওয়াটা খড়ের গাদায় সূচ খুঁজতে যাওয়ার মতই দুরূহ। কোনদিন মূল চুক্তিপত্রটা পড়ার সুযোগ হবে না, আহারে!
মদিনা সনদের মূল বিষয়বস্তু
সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ একটি জাতি গঠন করবে;
যুদ্ধ বা হানাহানি শুরু হবার মতো তীব্র বিরোধ তৈরি হলে বিষয়টি আল্লাহ এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ন্যস্ত হবে;
কোনো সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোনো প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদিনা বা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনো রূপ সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না;
মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
মদিনার উপর যে কোনো বহিরাক্রমণকে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে এবং সেই আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে।
অমুসলিমগণ মুসলিমদের ধর্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে না।
রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে;
অসহায় ও দুর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে;
সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদিনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে;
কোনো লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে, তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না;
মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে;
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক;
মুহাম্মদ-এর অনুমতি ব্যতীত মদিনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না;
মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।
পবিত্র যুদ্ধ
বদর যুদ্ধের আগে শান্তিবাহিনী একবার পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ব্যবসায়ী কাফেলার উপর অতর্কিতে হামলা করে অর্জন করে গনিমতের মাল। এভাবেই ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে তার গনিমতের মাল। তেমনি বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। রুক্ষ মরুভূমিতে যেখানে নেই জীবনের নিরাপত্তা, জীবন ও জীবিকা যেখানে অনিশ্চিত, নেই কর্মক্ষেত্র তখন দস্যুবৃত্তিই হতে সেখানে মহৎ পেশা। শান্তিবাহিনীর ছায়াতলে আসলে সব পাওয়া যায়। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের উপর জিহাদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ো, অর্জন করে নাও সম্পদ, অধিকৃত নারীদের করে নাও যৌনদাসী।
যতদিন বেঁচে আছো পৃথিবীতে ভোগ করো সুখে, আর জিহাদের যুদ্ধে মরে গেলে পাবে অনন্ত সুখের জীবন, মদের নদী আর সুন্দরী হুরি। অসাধারণ বিজ্ঞাপন। একজন অশিক্ষিত, উগ্র ও ধর্মান্ধ মানুষের সামনে এই বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তাকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব। তৎকালীন আরবে যুদ্ধে আটক নারীদেরকে সম্মান দিত হবে এমন সুন্দর কিছু নিয়মও ছিল। কিন্তু আল্লাহ নবীর মাধ্যমে সেই সমস্যা দূর করে দিলেন। এক আয়াতে আহমাদ ইবনু মানী (রহঃ) ….. আবূ সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আওতাস যুদ্ধে বহু বন্দ্বীনী আমাদের হস্তগত হয়। তাদের গোত্রে অনেকের স্বামী বর্তমান ছিল। বিষয়টি সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে উত্থাপন করলে এই আয়াত নাযিল হয় যে, وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلاَّ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ সকল সধবা নারী, কিন্তু অধিকারভূক্ত দাসীগণ (সধবা হলেও হালাল) (৪ঃ২৪) – সহিহ আবু দাউদ ১৮৭১, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১১৩২ [আল মাদানী প্রকাশনী]
ইমাম আবূ ঈসা (রহঃ) বলেন, এই হাদীসটি হাসান ছাওরীও এটিকে উছমান বাত্তী- আবূল খালীল-আবূ সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। রাবী আবূ খালীল-এর পূর্ণ নাম হলো সালিহ ইবনু আবূ মারয়াম। হাম্মাম (রহঃ) এই হাদীসটিকে কাতাদা-সালিহ আবূল খালীল-আবূ আলকামা হাশিমী আবূ সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। আবদ ইবনু হুমায়দ- হাববান ইবনু হিলাল- হাম্মাম সূত্রে আমার কাছে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
নাজিল হয়ে গেল যুদ্ধ আটক নারীদের সাথে অবাধে যৌনাচার করা যাবে। ইহুদিদের নিজেদের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, ধর্ম আছে, উন্নত সংস্কৃতি আছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে তারা মুহম্মদের নবীত্ব দাবীকে মেনে নিতে পারেনি। অতি সহজেই আমরা বুঝতে পারি ইহুদিরা মুহম্মদের আল্লাহ এবং তার নব্যুয়ত প্রাপ্তি নিয়ে হাসি, তামাশা করেছিল। আচ্ছা কোন মুসলিম সমাজে যদি কেউ নিজেকে নবী দাবি করে এবং নতুন ধর্ম প্রচার করতে চায় তাহলে মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কীরকম হবে বলতে পারেন? বলতে পারছেন না? একটু সহজ করে দিই, বাহা’ই হত্যাকাণ্ড হয়ত আপনাকে চিন্তার সুযোগ করে দিতে পারে।
পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখকঃ বিকাশ মজুমদার
মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী
নিউইয়র্ক, ইউএসএ
তারিখ: ১০ আগস্ট, ২০২৫
[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]