চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা: পদোন্নতির দিনে সহকারী অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, বোর্ড স্থগিত

উত্তেজনা: পদোন্নতির দিনে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষক পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে গত ৪ জুলাই ২০২৫ (শুক্রবার) একটি নজিরবিহীন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে উপাচার্য ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ শিক্ষার্থী, যাঁরা দাবি করেন—একজন শিক্ষক গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হওয়ার অভিযোগ ঘিরেই মূলত এই বিক্ষোভের সূত্রপাত।

AP1GczO1qvFH8 uHPhVRhoABg9p74z7PDbVa6QtS8uD63j ncSGDGc2zst cdZWuejHZpp5Ys32lz5bU 5UKT jEqAPXsfRR0OHeeUAOwYr4hVDIUJRRq UxUTiFWqDcGFoDhzUGyEH2HdowberqGVx939I9=w1170 h878 s no gm?authuser=0

 

ঘটনাপ্রবাহ

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির বোর্ড বসার কথা ছিল ৪ জুলাই ২০২৫ (শুক্রবার) বিকেল ৩টায়, উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে। কিন্তু এর আগেই, দুপুর আড়াইটার দিকে একাধিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয় এবং পরে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। ফলে উপাচার্য ড. মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন এবং পদোন্নতি বোর্ডের সদস্যরা ভবনের ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

AP1GczNOJShxoQLX2cSzacHA 2B3ilxg8TC5XGraqPmYnpiRHuAA3gVgslRlCu4iPht6USPFm3 S3z1mlBCtk8814RoYjFdQ574Xg3vtRbXYTQ 4sNTK6S3zurMkzbix7c02OueB J0QfsfKYPznwYmflK1C=w1024 h576 s no gm?authuser=0

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরীর ওপর হামলার মামলার ২০তম আসামি। এছাড়াও, তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগও আনা হয়।

তবে অভিযুক্ত শিক্ষক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর দাবি, তিনি কোনো মামলার আসামি নন এবং বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, “আমি ঢাকায় চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছিলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ছুটি নিয়েছিলাম। মামলার বাদীকেও আমি চিনি না।”

AP1GczM2isuAkyBb64K7F0Pl8hCEKGppXOWzHFh5Y EeOlwERXte3VPhdZTSOw9PqNE Znl6pW1O9mM ldhyWV1JZ8D7dv7B0 YUqsefeC2UtOQ 0fqFJh5uMNTDfk hITEF6gQwrVxJxVAVFLjvKRi9eX98=w1170 h878 s no gm?authuser=0

 

ঘটনার সময় একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তীকে উত্তেজিত পরিস্থিতির মধ্যে কথা বলার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছি। আমাকে একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। আমি শান্তিপূর্ণভাবে জবাব দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে বাধা দেওয়া হয়।”

ভবনে উত্তেজনা ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির জন্য উপাচার্যের কক্ষে বোর্ড সভা শুরু হলে, আন্দোলনকারীদের একাংশ সেখানে উপস্থিত হন এবং সভার বিরোধিতা করেন। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও কক্ষজুড়ে হট্টগোলের মধ্যে শিক্ষক কুশল বরণ কথা বলতে চাইলে তাঁকে থামিয়ে দেন উপ-উপাচার্যরা।

AP1GczN9Pb27DgvyqkJSvK ZkQRx 5gDYzThU7lf5iy0to6ltQD3ZJ9l9asUT 119PVZtKKXo1Hn8Ms 82tfjHKtfEAqdASuCtMcj3ybePgxuh0BfDgXX dsZWq1Dcrd6u2uWmyDuktwiQKQEx3pLGRWKcqp=w1200 h800 s no gm?authuser=0

 

আন্দোলনকারীরা তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন, যেখানে তাঁকে “ফ্যাসিবাদের দোসর”, “র-এর এজেন্ট”, “ইসকনের সদস্য” প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের একাংশ বলেন, ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরীর উপর হামলার মামলায় কুশল বরণ চক্রবর্তী ২০তম আসামি হিসেবে উল্লেখ রয়েছেন। মামলাটি দায়ের হয় ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর।

প্রায় দুই ঘণ্টা চলমান বিক্ষোভের পর বিকেল ৫টার দিকে প্রশাসন জানায়, ড. কুশল বরণের পদোন্নতি বোর্ড স্থগিত করা হয়েছে। এরপর শিক্ষার্থীরা তালা খুলে দেয় এবং বিক্ষোভ শেষ হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “সংবাদমাধ্যমে কিছু সংবেদনশীল তথ্য এবং শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বোর্ড স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি ২৪ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার জন্য তোলা হবে।”

অতীত বিতর্ক

একইসঙ্গে, পূর্বের আরেকটি বিতর্কিত ঘটনার প্রসঙ্গও সামনে আনা হয়। ২০২৪ সালের ২৬ অক্টোবর, কুশল বরণ চক্রবর্তী ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা’ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড”, “বিদেশি চক্রান্ত” ও “বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন” করার অভিযোগ তোলা হয়।

AP1GczMlSUHdSSy LzesaOPA1PrDAGEpYFUGCUk5D OsrVkEKDn1CjusNrev79cq1B4QxS5 6RT5xrRsIVKFV4MEYWDZL5w213ZIpzgnDIkShcSp6a8OcolLMB0wBCyAcYpDhWHxoZ8 vfKvRp8 Fnwe2K7M=w1172 h878 s no gm?authuser=0

তবে ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী দাবি করেন, এসব উদ্যোগ গবেষণা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজের অংশ ছিল। তিনি বলেন, “আমি কোনো সংগঠনের সদস্য নই, বরং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করি—সেটিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।”

শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ

আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী ছাত্র শিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ প্রমুখ। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পাশাপাশি আরও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছে। তাদের দাবি:

AP1GczN o2ZMYBJVXlFFN6WrN5tevviqj nidn 01NR4Yuw6kyRPRRsHonELRFCeMq8bnYQ86ru Qc31KJceM2a e4mjBG5w KgBo3H64naBGQIr8LhXzT07uQUPGRVaHr 1g0ypD5qSGmW2PepEZIXD7p10=w1024 h576 s no gm?authuser=0

ড. কুশল বরণ ও অন্যান্য বিতর্কিত শিক্ষকদের একাডেমিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। ৫ আগস্টের মধ্যে যেসব শিক্ষক-কর্মচারী জুলাইয়ের আন্দোলন দমন বা বিরোধিতায় যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী পরিবেশ’ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষক সমাজ ও প্রশাসনিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন

ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, শিক্ষকের মর্যাদা, এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে। কোনো অভিযোগের সঠিক তদন্ত ও প্রক্রিয়া ছাড়া একজন শিক্ষকের পদোন্নতি প্রক্রিয়া এভাবে জনরোষ ও মব চাপের মুখে স্থগিত হওয়া এক উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত।

AP1GczMlSUHdSSy LzesaOPA1PrDAGEpYFUGCUk5D OsrVkEKDn1CjusNrev79cq1B4QxS5 6RT5xrRsIVKFV4MEYWDZL5w213ZIpzgnDIkShcSp6a8OcolLMB0wBCyAcYpDhWHxoZ8 vfKvRp8 Fnwe2K7M=w1172 h878 s no gm?authuser=0

ড. কুশল বরণ বলেন, “৫০ জন মানুষ মিলে চিৎকার করলেই কি একজন শিক্ষকের ক্যারিয়ার থেমে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কি এখন সত্য যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত নেবে?” তিনি আরও বলেন, “যারা আমাকে ইসকনের সদস্য, রাষ্ট্রবিরোধী বা এজেন্ট বলছে, তারা যদি আমার কার্যক্রম খতিয়ে দেখে, তাহলে সত্য বেরিয়ে আসবে।”

পরবর্তী পদক্ষেপ ও প্রশাসনের আশ্বাস

শিক্ষকদের একটি অংশ মনে করেন, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো শিক্ষককে পদোন্নতি প্রক্রিয়া থেকে এভাবে বাদ দেওয়া উচিত নয়। তাঁদের মতে, শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক, তবে বিচারহীন জনচাপ প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি আলোচনায় তোলা হবে।

তারিখ: ০৪ জুলাই, ২০২৫

এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: manobkantha, thedailystar, bdnews24, banglanews24, sarabangla, dhakapost, bd-pratidin, somoynews, kalerkantho

Click here to read this article in English

আরো খবর পড়ুন

শিশুর গলায় ছুরি ধরে মাকে
নারী

পঞ্চগড়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুর গলায় ছুরি ধরে মাকে গণধর্ষণ, আপোষের চাপ 

পঞ্চগড়ের সদর উপজেলায় এক মর্মান্তিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে । শুক্রবার (৪ জুলাই) দিবাগত রাতে দুই বছর বয়সী একটি শিশুর গলায়

Read More »
স্বামীকে রাতভর আটকে Gang-Rape of Housewife and Overnight Tortur
নারী

ভোলায় গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও স্বামীকে রাতভর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ

ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং চাঁদা আদায়ের উদ্দেশ্যে স্বামীকে আটকে রেখে মারধরের ঘটনায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা

Read More »
নারীকে এসিডে দগ্ধ করে
নারী

অন্তঃসত্ত্বা নারীকে এসিডে দগ্ধ করে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ফেলে যায়

বরিশাল-ভোলা মহাসড়কের পাশে জঙ্গল থেকে হাত-পা বাঁধা এবং পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ।

Read More »
সংখ্যালঘুদের দেয়া একটি গালি
মতামত

বাংলাদেশে ‘মালাউনের বাচ্চা’ সংখ্যালঘুদের দেয়া একটি গালি!

প্রবাদে আছে, যদি কোন গ্রামের অবস্থা বুঝতে চাও। তবে সেই গ্রামের শিশুদের অবস্থা দেখে নিও। তাহলেই বুঝা যাবে গ্রামের অবস্থা।

Read More »
ফজর আলী এখনো পলাতক
নারী

মুরাদনগরে হিন্দু নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা: অভিযুক্ত ফজর আলী এখনো পলাতক

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ফজর

Read More »
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সংখ্যালঘুদের কান্না
মতামত

সংখ্যালঘুদের কান্না, রাষ্ট্রের নীরবতা: মানবাধিকারের ভয়াবহ পরাজয়

ইন্ডিয়ায় একটা বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে গেলো। আমরা মুসলিমরা সেই দুঃখে এখনও কাঁদি। বাংলাদেশে প্রতি

Read More »
Scroll to Top