April 27, 2025 1:50 pm

নিরাপদ শৈশব: সচেতনতাই সুরক্ষার প্রথম ধাপ
শিশুদের শেখানো হোক ‘ভালো স্পর্শ’ ও ‘খারাপ স্পর্শ’

খারাপ স্পর্শ
শিশুদের শেখানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো “ভালো স্পর্শ” এবং “খারাপ স্পর্শ” সম্পর্কে সচেতন করা। এই ধারণাগুলোর মাধ্যমে শিশুরা নিজেকে রক্ষা করতে, অনুপযুক্ত আচরণ চিনতে ও সাহায্য চাইতে সক্ষম হয়।শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রত্যেক অভিভাবক ও যত্নশীলের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

 

শৈশব প্রতিটি শিশুর জন্মগত অধিকার, আর এই শৈশব যেন নিরাপদ ও সুন্দর হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা শিশুর কোমল মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। তাই শিশু ও অভিভাবক উভয়কেই সচেতন হতে হবে, জানতে হবে কীভাবে শৈশবকে নিরাপদ রাখা যায়।  শিশুকে ‘ভালো স্পর্শ’ ও ‘খারাপ স্পর্শ’ সম্পর্কে শেখানো অভিভাবক ও শিক্ষকদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

 

বিশ্বজুড়ে শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র

মার্কিন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের সংস্থা আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স-এর গবেষণা পত্রিকা “পেডিয়াট্রিক্স”-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে ২ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় এক বিলিয়ন শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান ব্যুরো (অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্স) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নিপীড়নকারী ছিল পরিচিত ব্যক্তি—যারা পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবের চেনাজানা মানুষ।

বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মাত্রা উদ্বেগজনক

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে ১,৩৮৩ জন শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭৬ শতাংশ বেশি। অথচ, প্রকৃত সংখ্যা আরও ভয়াবহ হতে পারে, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা নির্যাতনের কথা প্রকাশ করে না।

ব্র্যাক-এর একটি ব্লগ পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ৭৫ শতাংশ শিশু নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া হয়রানি বা নিপীড়নের কথা কাউকে বলে না। এর পেছনে মূল কারণ—

  • লজ্জা ও ভয়
  • শরীরের ব্যক্তিগত অঙ্গ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা
  • ভালো স্পর্শ-খারাপ স্পর্শের পার্থক্য না বোঝা
  • নির্যাতনকারীর হুমকি বা ভয় দেখানো

ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ: শিশুকে কীভাবে শেখাবেন?

ইউনিসেফের কিপিং মাই বডি সেইফ বুকলেটে শিশুদের জন্য স্পর্শকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে:

১. ভালো স্পর্শ: যা শিশুকে আনন্দ দেয়, যেমন—

  • আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া
  • হ্যান্ডশেক করা
  • পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেওয়া

২. অনিরাপদ স্পর্শ: যা শারীরিক বা মানসিক কষ্ট দেয়, যেমন—

  • চড়-থাপ্পড়, ঘুষি বা ধমক দেওয়া

৩. মন্দ স্পর্শ: যা শিশুকে অস্বস্তিকর বা ভীত করে তোলে, যেমন—

  • জোর করে কোথাও স্পর্শ করা
  • ব্যক্তিগত অঙ্গ (যা সাধারণত কাপড়ে ঢাকা থাকে) স্পর্শ করা
  • গোপনে স্পর্শ করতে বলা এবং তা কাউকে বলতে নিষেধ করা
  • শিশুর আপত্তি সত্ত্বেও জোরপূর্বক আলিঙ্গন, চুমু বা গা ছুঁয়ে দেখা।
  • গোপনীয়ভাবে স্পর্শ করা এবং শিশুকে এ বিষয়ে কাউকে না বলার জন্য বলা।

খারাপ স্পর্শ শিশুদের জন্য মানসিক ও আবেগগতভাবে ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটি তাদের মনে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক বা অপরাধবোধ সৃষ্টি করতে পারে।

শিশুকে সচেতন করতে করণীয়

  • শরীরের ব্যক্তিগত অঙ্গ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিন
  • ভালো ও খারাপ স্পর্শের পার্থক্য বোঝান
  • কোনো অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটলে অবশ্যই বিশ্বস্ত কারো কাছে বলতে উৎসাহিত করুন
  • শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তাকে নিরাপদ বোধ করান

১. সহজ ভাষা ব্যবহার করুন: বোঝান যে তাদের শরীর তাদের নিজের এবং তারা “না” বলার অধিকার রাখে।
শরীরের “নিরাপদ স্থান” ধারণা পরিচিত করান এবং তাদের গোপন অঙ্গগুলোর সঠিক নাম শেখান যাতে প্রয়োজনে তারা কারও কাছে সহজে অভিযোগ জানাতে পারে।

২. তাদের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা দিন: শেখান যে অনুপযুক্ত স্পর্শের ক্ষেত্রে তারা জোর দিয়ে “না” বলতে পারে, এমনকি সেটি পরিচিত ব্যক্তি বা আত্মীয় হলেও। বোঝান যে তারা যেন কখনো খারাপ স্পর্শের বিষয়টি গোপন না রাখে।

৩. ভূমিকাভিনয়ের (Role Play) মাধ্যমে শেখান: বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে অনুশীলন করুন যেখানে শিশুরা অনুপযুক্ত স্পর্শ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। যেমন, “থামো! এটা আমি পছন্দ করছি না,” বা “আমি বড়দেরকে জানিয়ে দেবো।”

৪. নিরাপদ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা: শিশুদের শেখান যে তারা বিপদে পড়লে কোন নির্ভরযোগ্য বড়দের কাছে যেতে পারে, যেমন বাবা-মা, শিক্ষক বা স্কুল কাউন্সেলর।

৫. খোলামেলা আলোচনা করুন: এমন পরিবেশ তৈরি করুন যাতে শিশুরা সহজেই তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারে এবং কোনো রকম ভয় বা শাস্তির আশঙ্কা না থাকে।

শিশুরা খারাপ স্পর্শের শিকার হলে যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারেশিশুরা সবসময়  তাদের অভিজ্ঞতা সরাসরি প্রকাশ করে না। তবে কিছু আচরণগত পরিবর্তন তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করতে পারে। সতর্কতামূলক লক্ষণগুলো হলো:

• অজানা ভয়, উদ্বেগ বা সামাজিক মেলামেশায় শিশুর অনাগ্রহ।
• হঠাৎ করে খাওয়া বা ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন।
• প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা বা বয়স বৃদ্ধির বিপরীত লক্ষণ যেমন আঙুল চোষা।
• নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে একা থাকতে অনীহা।

যদি কোনো শিশু খারাপ স্পর্শের অভিযোগ করে তবে কী করবেন?

যদি কোনো শিশু আপনাকে খারাপ স্পর্শের বিষয়ে বলে, তবে মনযোগ দিয়ে শিশুর কথা শুনুন। অত্যন্ত সংবেদনশীলতা ও যত্নের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানান:

• শান্ত থাকুন: সহানুভূতি দেখান এবং শিশুকে আশ্বস্ত করুন যে তারা নিরাপদ এবং তাদের কথা বলার সিদ্ধান্তটি ঠিক হয়েছে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন “তোমার সাথে যেটা ঘটেছে সেটা খুব অন্যায় হয়েছে, তবে আমরা তোমার পাশে আছি”
• বিচার ছাড়া শুনুন: শিশুকে তাদের অভিজ্ঞতা নিজের ভাষায় বলতে দিন এবং বাধা দেবেন না। পুরো ঘটনাটি তার কাছ থেকে শোনার চেষ্টা করুন।
• ঘটনাটি জানিয়ে দিন: শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত কর্তৃপক্ষ বা শিশু সুরক্ষা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
• পেশাদার সহায়তা নিন: কাউন্সেলিং শিশুকে মানসিক ও আবেগগতভাবে সুস্থ হতে সহায়তা করতে পারে।

• আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করুনঃ যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচে দেওয়া হলো:

•  বাড়ি ও স্কুলে ব্যক্তিগত সীমারেখা সম্পর্কে পরিষ্কার নিয়ম তৈরি করা।
•  স্কুলগুলোতে শিশুদের নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা।
•  শিশুদের বড়দের সঙ্গে যোগাযোগের সময় পর্যবেক্ষণ করা।

শিশুদের ভাল স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে শেখানো তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। শিশুদের সচেতন করে তোলা, খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলা এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে সক্রিয় থাকা তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং বিপদের সময় সহায়তা চাইতে সক্ষম করে। অভিভাবক, অভিভাবক ও শিক্ষকরা একসঙ্গে কাজ করলে একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে শিশুরা নির্ভয়ে বেড়ে উঠতে পারবে। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের শৈশব যেন নিরাপদ ও আনন্দময় হয়, সে জন্য সচেতনতা গড়ে তুলুন। কারণ, একটি সুরক্ষিত শৈশবই গড়ে তুলবে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ

তারিখ: ২৫ মার্চ, ২০২৫

লেখক: নাফিস সাদিক শাতিল

সম্পাদক ও প্রকাশক, মাইনোরিটিওয়াচ

Click here to read this article in English

আরো খবর পড়ুন

মুর্শিদাবাদ বিক্ষোভ
ধর্ম

মুর্শিদাবাদ বিক্ষোভ: বাংলাদেশ ও ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত সহিংসতার অভিযোগ

সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি, ধুলিয়ান এবং সামসেরগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সহিংসতা রাজ্যের গোয়েন্দা মহলে গভীর উদ্বেগ ও নানা

Read More »
ছায়ায় প্রতিবন্ধী নারীরা
বাংলা

নিরাপত্তাহীনতার ছায়ায় প্রতিবন্ধী নারীরা: রংপুর, হবিগঞ্জ ও পিরোজপুরে প্রতিবন্ধী নারীদের উপর যৌন সহিংসতার ভয়াবহ অভিযোগ

বাংলাদেশের তিনটি জেলার পৃথক তিনটি ঘটনায় প্রতিবন্ধী নারীদের ওপর যৌন সহিংসতার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাগুলো একদিকে যেমন মানবাধিকারের চরম

Read More »
বিদেশী নারীকে ধর্ষণ Feni
নারী

বিদেশী নারীকে ধর্ষণ ও প্রতারণার অভিযোগে ফেনীতে মামলা, অভিযুক্ত গ্রেপ্তার

বাংলাদেশের ফেনী জেলার শর্শদি ইউনিয়নে থাইল্যান্ডের এক নারী নাগরিকের (৪০) দায়ের করা ধর্ষণ ও প্রতারণার মামলায় মোখসুদুর রহমান (৪৮) নামের

Read More »
ওয়াকফ আইন
ধর্ম

অশান্ত পশ্চিমবঙ্গ: বিতর্কিত ওয়াকফ আইন ঘিরে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন

ভারতের সংসদে পাস হওয়া বিতর্কিত ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫-এর বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলায় ব্যাপক

Read More »
তামিলনাড়ুতে ঋতুস্রাবের
ধর্ম

ভারতের তামিলনাড়ুতে ঋতুস্রাবের সময় দলিত ছাত্রীকে বাইরে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার অভিযোগ

ভারতের তামিলনাড়ুতে ঋতুস্রাবের সময় দলিত ছাত্রীকে বাইরে বসিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঐ ছাত্রীকে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশে নিষেধ করা হয় এবং

Read More »
Scroll to Top