October 30, 2025 4:38 pm

পশ্চিমবঙ্গের গীধগ্রামের ইতিহাস গড়ার মুহূর্ত
২০০ বছরের প্রথা ভেঙে দলিত সম্প্রদায়ের মন্দিরে পূজার অধিকার

দলিত সম্প্রদায়ের
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার গীধগ্রামে এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে উঠেছে। প্রায় দুশো বছর ধরে চলে আসা এক প্রথা ভেঙে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ এবার স্থানীয় শিব মন্দিরে পূজা দিতে সক্ষম হয়েছেন। বুধবার (১২ মার্চ,২০২৫) থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ,২০২৫) পর্যন্ত এই মন্দিরে দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজন সদস্য পূজা অর্পণ করেন। এটি তাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কারণ এর আগে তাদের এই মন্দিরে প্রবেশ কিংবা পূজা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না।

 

প্রাচীন প্রথার অবসান
গীধগ্রামের এই শিব মন্দিরটি স্থানীয়ভাবে গীধেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। গ্রামের দলিত সম্প্রদায়, যারা মূলত ‘মুচি’ সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তাদের পদবী ‘দাস’, তারা দীর্ঘদিন ধরে এই মন্দিরে পূজা দেওয়ার অধিকারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের অভিযোগ, প্রায় দুশো বছর ধরে তাদের এই মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, এমনকি মন্দিরের সিঁড়িতেও উঠতে দেওয়া হতো না।

পূজা দাস নামে এক নারী, যিনি বুধবার প্রথমবারের মতো এই মন্দিরে পূজা দিতে পেরেছেন, তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছ থেকেও শুনে এসেছি যে আমাদের সম্প্রদায়কে ২০০ বছর ধরে এই মন্দিরে পূজা দিতে দেওয়া হত না। একজন হিন্দু হয়েও এই মন্দিরে পূজা দিতে পারতাম না আমরা।”

484345364 122109783326794668 3951725496837465646 n.jpg? nc cat=101&ccb=1 7& nc sid=127cfc& nc ohc=ckWMLIMwLh0Q7kNvgE9RJFl& nc oc=AdnVy8Iv965vQY1awJl3bMjgvEAZcDLAftZxOdfOS2h4k cg6EUZDpmaCksAyTZXwEAoApaEvNZ2zw6eHodeURK5& nc zt=23& nc ht=scontent.fktm3 1

প্রশাসনের হস্তক্ষেপ
এই দাবি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে গীধগ্রামে মিছিল ও সমাবেশ হচ্ছিল। অবশেষে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের হস্তক্ষেপে বুধবার দলিত সম্প্রদায়ের পাঁচজন সদস্যকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারা পূজা অর্পণ করেন। বৃহস্পতিবারও এই সম্প্রদায়ের আরও কয়েকজন সদস্য মন্দিরে পূজা দিতে যান।

কাটোয়া মহকুমার শাসক অহিংসা জৈন বলেন, “ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে নিজের পছন্দের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করার। পশ্চিমবঙ্গে এধরনের জাতপাতের বিভেদ চলে না। তবে কিছু ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে এরকম একটা প্রথা চলে আসছিল। কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দিতে পারি না।”

তিনি আরও বলেন, “বিষয়টা জানার পরেই সব পক্ষকে নিয়ে আমরা বৈঠক করি, তাদের বোঝানো হয় যে এটা ভুল। বর্তমান সময়ে এসে এধরনের বৈষম্য করা যায় না। তারাও ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন। বুধবার আমি নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম ওই দাস সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম পুরো সময়টা ওখানে।”

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম
দলিত সম্প্রদায়ের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে এই মন্দিরে পূজা দেওয়ার অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আসছিলেন। তারা প্রশাসনের কাছে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন, যাতে লেখা ছিল, “মন্দিরে পূজা দিতে গেলে আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার, গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ বলে আমরা নিচু, মুচি, অস্পৃশ্য জাত, মন্দিরে ওঠার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমরা পূজা দিলে নাকি মহাদেব অপবিত্র হয়ে যাবে।”

গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ দাস বলেন, “এমনিতে অন্যান্য মন্দিরে আমরা পূজা দিতাম। আবার অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পাওয়া বা চাষের ক্ষেতে কাজ করা, সামাজিক মেলামেশায় কোনো কিছুতেই কোনো বাধা দিত না কেউ। শুধু এই গীধেশ্বর মন্দিরেই আমাদের উঠতে দেওয়া হত না। এমনকি সিঁড়িতেও উঠতে পারতাম না আমরা।”

সমাজের ভেতরের বিভাজন
পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চ নামের একটি সংগঠন এই দলিত সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সংগঠনটির পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক তমাল মাজি বলেন, “গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে আমরা যেটা বুঝতে পারি যে অন্য কোনো কিছুর ক্ষেত্রেই এই বৈষম্যের সম্মুখীন তারা হন না, ব্যতিক্রম শুধু এই মন্দিরটির ক্ষেত্রে। গ্রামে বেশিরভাগই নানা তপশিলি জাতির মানুষ, কিছু ব্রাহ্মণ, কিছু মুসলমান এবং অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন।”

তিনি আরও বলেন, “আশ্চর্যের বিষয় হল এই দাস পরিবারের সদস্যদের পূজা দিতে বেশি বাধাটা দিতেন ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন। আবার বাগদি, ডোমেদের মতো যেসব অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, তাদের একাংশও এই বৈষম্যকে সমর্থন করতেন, দাসদের বাধা দিতেন।”

জাতিগত বৈষম্য ও রাজনীতি
পশ্চিমবঙ্গে জাতিগত বৈষম্য বা দলিত সম্প্রদায়কে বাধা দেওয়ার ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেলেও গত দেড় দশক ধরে এ রাজ্যের রাজনীতিতে জাতিগত সমীকরণ প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় জাতিগত জনসংখ্যার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই প্রবণতা নতুন। বিশেষ করে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দল নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকে।

গ্রামের দাস পরিবারগুলোর কেউ কেউ বলছেন যে এখন প্রশাসন-পুলিশ দেখে হয়তো কেউ কিছু বলছে না, তবে আতঙ্ক একটা আছে। সেকারণেই এখনও পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে গীধগ্রামে। মহকুমা শাসক অহিংসা জৈন বলছেন, “শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় নি সেখানে। কিন্তু আমরা সাবধানতা অবলম্বন করার জন্যই পুলিশ রেখে দিয়েছি। ধীরে ধীরে সরিয়েও নেওয়া হবে বাহিনীকে।”

এই ঘটনা শুধু গীধগ্রামের নয়, শুধু দলিত সম্প্রদায়ের নয়, সমগ্র ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি প্রমাণ করে যে সংবিধান প্রদত্ত সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক ও প্রশাসনিক সচেতনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

তারিখ: ১৪ মার্চ, ২০২৫

Click here to read this article in English

আরো খবর পড়ুন

পাথর দিয়ে নির্মম হত্যা স্বর্ণময়ীর মৃত্যু
মতামত

“ভচকানো” বাংলার প্রতিশোধ: স্বর্ণময়ীর মৃত্যু নয়, এক কর্মসংস্কৃতির চপেটাঘাত

“যার ব্রে’স্টের শেপ এরকম ভচকানো, তার বাংলাটা ভচকানো হবে।” এই এক বাক্যই যথেষ্ট বুঝিয়ে দেয়, কেমন বিষাক্ত মানসিকতা লুকিয়ে থাকে

Read More »
শৈলকুপায় প্রতিমা ভাঙচুর Idol Vandalism in Shailkupa
ধর্ম

শৈলকুপায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় প্রশ্ন, ষড়যন্ত্র নাকি মানসিক অসুস্থতা?

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায় আসন্ন দুর্গাপূজাকে ঘিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভোররাতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত

Read More »
হিন্দু নিশ্চিহ্নের ইহুদিদের ভাগ্য ইসলামের সাথে কমিউনিজমের দুর্গোৎসবে
মতামত

বিকাশ মজুমদারের কলামঃ ইসলামের সাথে কমিউনিজমের অবৈধ সম্পর্ক

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বাম রাজনীতি করা লোকজন সাধারণত নিরীশ্বরবাদী হয়ে থাকেন। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে বাম রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে ইসলামের

Read More »
Scroll to Top