বাংলাদেশের দিনাজপুরে ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়, যার ফলে সে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক আঘাতে ভুগছে। বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, আসামির দণ্ডাদেশ, এবং অবশেষে জামিনপ্রাপ্তির বিষয়টি একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আসামির জামিনপ্রাপ্তির পর বর্তমানে আবারও প্রায় দশ বছর আগের ‘দিনাজপুরে শিশু ধর্ষণ’ এর ঘটনাটি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঘটনার বিবরণ: ১৮ অক্টোবর ২০১৬
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার একটি গ্রামে ১৮ অক্টোবর ২০১৬ সালে এক প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে খেলার সময় পাঁচ বছর বয়সী শিশুটি নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, পরদিন সকালে পরিবারের সদস্যরা তাকে বাড়ির পাশে হলুদের খেতে রক্তাক্ত অবস্থায় অচেতনভাবে পড়ে থাকতে দেখেন।
শিশুটির শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল, তার প্রজনন অঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং উরুতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আসামি গ্রেপ্তার ও বিচারের শুরু: অক্টোবর ২০১৬ – জানুয়ারি ২০২২
শিশুটির বাবা ২০ অক্টোবর ২০১৬ সালে পার্বতীপুর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। চার কন্যা সন্তানের পিতা সাইফুল ইসলামকে প্রধান আসামি করা হয়। ২৪ অক্টোবর পুলিশ সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে।
তদন্ত শেষে, দিনাজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা গড়ায়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর, ১০ জানুয়ারি ২০২২ সালে ট্রাইব্যুনাল আসামি সাইফুল ইসলামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেয়।
শিশুটির দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি
এই পাশবিক নির্যাতনের কারণে শিশুটির মূত্রথলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং প্রতিদিন ডায়াপার ব্যবহার করতে হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তার শরীরে একাধিক অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, কিন্তু এখনো সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। শিশুটির মা-বাবার আর্থিক দুরবস্থার কারণে তার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বিভিন্ন এনজিও সহায়তা করছে।
শিশুটি মানসিকভাবে এখনো সুস্থ হতে পারেনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার মানসিক পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কাউন্সেলিং ও মনোচিকিৎসার প্রয়োজন। তার মা জানিয়েছেন, “আমার মেয়ে সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে, বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।”
আসামির জামিন ও বিতর্ক: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
নৃশংস এই অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাইফুল ইসলাম ৮ বছর ৪ মাস কারাভোগের পর ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে জামিনে মুক্তি পান। হাইকোর্টের আদেশে ‘দীর্ঘদিন হাজতবাস’ করার ভিত্তিতে জামিন প্রদান করা হয়।
শিশুটির বাবা এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন: “বিচার তো পাইছিলাম, তাইলে এমন হইল ক্যানে? যাবজ্জীবনের আসামি ছাড়া পাইল ক্যানে?”
শিশুটির পরিবার ভয়ে আতঙ্কিত, কারণ সাইফুল ইসলাম তাদের বাড়ির কাছেই বসবাস করছে। ধর্ষণের শিকার শিশুটির মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে, সে এখনো স্কুলে যেতে পারে না। তার মা জানান, “সে সবসময় আতঙ্কে থাকে, আমরা পর্যন্ত বাইরে যেতে ভয় পাই।”
জামিনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ও আইনি জটিলতা
‘আমরাই পারি’ সংগঠনের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক এই জামিনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই জামিনের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার পরিবারের জীবন আরো ঝুঁকিতে পড়ল। আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যাবে এবং অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।”
সরকারি কৌঁসুলি নাজমা পারভীন (জেবা) জানিয়েছেন, মামলাটি এখনো চলমান রয়েছে এবং বাদীপক্ষ চাইলে এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। আইনজীবীরা মনে করছেন, এই জামিন আইন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
এই ঘটনা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। শিশুটির জীবন এখনো স্বাভাবিক হয়নি, অথচ দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা শুধু নির্যাতিতার পরিবার নয়, গোটা সমাজের নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
এই মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটি স্পষ্ট যে, বিচারপ্রাপ্ত আসামির মুক্তি শুধু ভুক্তভোগী পরিবার নয়, ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতিও বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ডেইলি স্টার, ১০ জানুয়ারি ২০২২, চ্যানেল আই অনলাইন, ২৪ অক্টোবর ২০১৬, প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর ২০২১
অতিরিক্ত তথ্যসূত্রঃ আজকের পত্রিকা ১০ জানুয়ারি, ২০২২, বিডিনিউজ২৪ ১০ জানুয়ারি, ২০২২, এই মুহুর্তে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
প্রকাশকালঃ ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫