বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে অবনতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) বা মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন। গত ২৬ মার্চ প্রকাশিত তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কথা উল্লেখ করে সরকারের সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে জোরালো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
ইউএসসিআইআরএফ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং জুলাই আগস্টের সহিংস বিক্ষোভের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু ও আহমদিয়া মুসলিমদের ওপর হামলা বেড়েছে। হিন্দু সংগঠনগুলোর অভিযোগ, মন্দির ভাঙচুর ও গোষ্ঠীগত সহিংসতা (মব ভায়োলেন্স) বৃদ্ধি পেয়েছে, যাতে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। যদিও এসব হামলার পেছনে ধর্মের চেয়ে রাজনৈতিক কারণই বেশি দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা মুহাম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানোর জন্য প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সংখ্যালঘু সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। সম্প্রতি ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছেন হাইকোর্টের দুই বিচারক। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ‘খ্রিস্টান রাষ্ট্র’ গঠনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছিলেন।
নভেম্বরে, হিন্দু ধর্মগুরু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটক করা হয়। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সংঘর্ষে একজন মুসলিম আইনজীবী নিহত হন। একই মাসে, সরকারের কাছে সুরক্ষার দাবিতে প্রায় ৩০,০০০ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিক্ষোভ করেন।
এদিকে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ধর্মীয় উপকরণের অবমাননা ও গোষ্ঠীগত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমারে সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। অক্টোবরে, বাংলাদেশের কেয়ারটেকার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও দ্রুত পুনর্বাসনের আহ্বান জানায়।
ইউএসসিআইআরএফ-এর পূর্ণ প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য
ইউএসসিআইআরএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:
“বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক হামলার কারণে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে নেওয়া সহিংস অভিযানে ২০০ জন নিহত হওয়ার পর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর, হিন্দু সম্প্রদায় তাদের ওপর হামলা বৃদ্ধি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। এসব হামলার মধ্যে মন্দির ভাঙচুর এবং গোষ্ঠীগত সহিংসতার (মব ভায়োলেন্স)ঘটনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একই সময়ে, প্রচলিত ও সামাজিক গণমাধ্যমে মিথ্যা বা ভিত্তিহীন সহিংসতার অভিযোগ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ ইউনুস, তাকে অবমাননা করা। শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর সংঘটিত সহিংসতায় শত শত হিন্দু নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যদিও প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে এসব হত্যাকাণ্ড ধর্মের চেয়ে রাজনৈতিক সংযুক্তির কারণে বেশি ঘটেছে। আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ও তাদের ওপর শারীরিক হামলা ও সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ করেছে। এসব ঘটনা ও অন্যান্য হামলার প্রতিক্রিয়ায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।
তবে এসব প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক চাপ এবং নিপীড়ন আরও বেড়েছে। জুলাইয়ের বিক্ষোভের আগে, বাংলাদেশের হাইকোর্টের দুই বিচারক ধর্ম অবমাননার (ব্লাসফেমি) শাস্তি আরও কঠোর করার পক্ষে মত দেন, যার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বিতর্কিত মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে খ্রিস্টানদের একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র চলছে।
নভেম্বরে, হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে বাংলাদেশের পতাকাকে অবমাননা করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়, যখন তিনি হিন্দুদের সুরক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন। এই গ্রেপ্তারের ফলে তার হাজারো সমর্থক পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যেখানে এক মুসলিম আইনজীবী নিহত হন। একই মাসে, আনুমানিক ৩০,০০০ হিন্দু সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে হামলা ও হয়রানি থেকে রক্ষা করার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করে।
পুরো বছরজুড়ে, পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে আগত প্রধানত মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীরা গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হতে থাকে, যার মধ্যে কক্সবাজারের শিবিরে গণহিংসা ও ধর্মীয় উপকরণ ধ্বংসের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কারণে আরও হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। অক্টোবর মাসে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানায় যে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হোক, যাতে সেখানে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা সহায়তা পেতে পারে এবং দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
সংখ্যালঘু সুরক্ষায় সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
ইউএসসিআইআরএফের প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সরকারি প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
তবে মার্কিন প্রতিবেদনে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের জন্য ‘বিশেষ উদ্বেগের’ বা ‘নজরদারির’ তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এই তালিকায় থাকা দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নিয়ন্ত্রণ বা সাহায্য বন্ধের মতো পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিশেষ উদ্বেগের তালিকায় থাকা দেশগুলো হলো: চীন, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, সৌদি আরব, রাশিয়া, কিউবা, ইরিত্রিয়া, নিকারাগুয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরান।
অন্যদিকে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণে নজরদারির তালিকায় উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, আজারবাইজান, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, উজবেকিস্তান ও তুরস্ক।
মার্কিন প্রতিবেদনে ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ যেমন নিষেধাজ্ঞা, ভিসা সীমিতকরণ ও আর্থিক সহায়তা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
তারিখ: ২৯ মার্চ ২০২৫
তথ্যসূত্র: newagebd, thesun24, USCIRF Report
Click here to read this article in English