বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম তিন্দু ইউনিয়নের গভীর জঙ্গল থেকে খিয়াং সম্প্রদায়ের এক নারী, চিংমা খিয়াং (২৯), এর লাশ উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে উদ্বেগ, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। নিখোঁজের একদিন পর সোমবার বিকেলে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি তিন সন্তানের জননী ছিলেন, যাদের মধ্যে একজন মাত্র সাত-আট মাসের শিশু।
চিংমা খিয়াং রোববার সকালে জুম চাষের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে পাহাড়ে যান। তবে দুপুর গড়িয়ে গেলেও তিনি বাড়ি না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা খোঁজ নিতে শুরু করেন। একপর্যায়ে স্থানীয়রা পাহাড়ে বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখতে পান। চিহ্ন অনুসরণ করে তারা এক স্থানে চিংমার লাশ পড়ে থাকতে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে।
নিহতের শরীরে রক্তাক্ত আঘাতের চিহ্ন এবং বিবস্ত্র অবস্থায় লাশ পাওয়া যাওয়ায় ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে। তিন্দু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভাগ্যচন্দ্র ত্রিপুরা জানান, ঘটনাস্থলটি নেটওয়ার্কবিহীন একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। তিনি খবর পেয়ে পুলিশকে অবহিত করেন এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে।
থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাসির উদ্দিন মজুমদার জানান, নিহত নারী জুমে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছিলেন এবং পরে তার মরদেহ পাহাড়ি একটি নালায় পাওয়া যায়। ঘটনাটি তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে।
চিংমা খিয়াংয়ের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে পিসিপির সভাপতি অমল ত্রিপুরা বলেন, “এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পাহাড়িদের ওপর চলমান নিপীড়নের অংশ।” তিনি আরো উল্লেখ করেন, এর আগেও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়িদের ওপর হামলা ও দোকানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
পিসিপির সাধারণ সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা বলেন, “পাহাড়ি জনগণ তাদের দাবি ও অধিকারের কথা বললেই তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দেওয়া হয়, যা সাংবিধানিক অধিকারকে অস্বীকার করে।” তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর জোর দেন।
এদিকে, রাঙামাটি শহরে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে একটি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ হয়। মিছিলটি জেলা পরিষদ ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন বিভিন্ন ছাত্র, নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী সূচনা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির সুমিত্র চাকমা, খিয়াং স্টুডেন্টস ইউনিয়নের উসিচিং খিয়াংসহ অনেকেই এ ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বক্তারা বলেন, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তাদের সাহস বাড়ছে। পাহাড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে এবং নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। তারা দাবি করেন, প্রশাসন যেন দ্রুত তদন্ত শেষ করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করে।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার বিকেলে তিন্দু ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মংখয় পাড়ায় চিংমা খিয়াংয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল এবং লাশটি নির্মাণাধীন থানচি-রেমাক্রি-লেইক্রি সড়কের পাশে একটি নালার মধ্যে পাওয়া যায়।
এই ঘটনার পর বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলাতেও পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন খিয়াং কল্যাণ সংস্থা, দুর্বার নেটওয়ার্ক, সৃজন বান্দরবান, উইমেন অ্যাক্টিভিটি এবং উইমেন রিসোর্স অ্যাক্টিভিটির প্রতিনিধিরা।
জেলা প্রশাসন এই ঘটনার তদন্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, এটি দুর্ঘটনা, না হত্যাকাণ্ড তা নিশ্চিত হতে মৃতদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অপেক্ষা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগ সক্রিয়ভাবে বিষয়টি তদন্ত করছে।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার শহিদুল কাউছার জানান, ঘটনাস্থল থানচি সদর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে এবং খুবই দুর্গম। লাশ উদ্ধারে ইউপি চেয়ারম্যান, হেডম্যান ও কারবারী উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, নিহতের স্বামী থানায় মামলা করেছেন এবং পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে।
তারিখ: ০৮ মে, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: bdnews24, bdnews24, prothomalo, jugantor
Click here to read this article in English