বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অংশগুলোর একটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। এখানে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, কিন্তু মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে বলা যায়- তারা আসলে শিক্ষার নামে তামাশার ফর্দ খুলে বসেছে।
শিক্ষাগত সংখ্যালঘু বলতে কি শুধুই সংখ্যা বোঝানো হয়, নাকি শিক্ষার গুণগত মান, সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক স্বীকৃতি থেকেও একটি শ্রেণি পিছিয়ে থাকতে পারে?
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মানে দক্ষতায় সমৃদ্ধ হওয়া নয়। ধর্মীয় শিক্ষা হচ্ছে, কথিত মৃত্যুর পরের জীবনকে উদ্দেশ্য করে। তাই পৃথিবীতে বা বাস্তব জীবনে এই শিক্ষার কোন সুফল নেই। ধর্মীয় শিক্ষার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো ভাল-মন্দ বিবেচনা বোধ, তাই এখানে দক্ষ অদক্ষ প্রধান বিষয় নয়। অথচ পড়াশোনার উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে তৈরী করা।
মাদ্রাসা শিক্ষার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত— কওমি ও আলিয়া। কওমি মাদ্রাসাগুলো স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয় এবং সাধারণত ধর্মীয় পাঠ্যসূচির ওপর গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে, আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সরকার-নিয়ন্ত্রিত, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
তবুও দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রশ্ন উঠছে— মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা কি মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে? যদি থাকে, তবে কেন?
শিক্ষাগত সংখ্যালঘুত্ব: সংখ্যায় নয়, কাঠামোগত ব্যবধানেই মূল সমস্যা
সংখ্যার বিচারে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সংখ্যালঘু নয়। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক মিলিয়নের কাছাকাছি। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু সমস্যা হলো, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারার সাথে সংযোগ স্থাপনের তেমন কার্যকর কোনো উপায় নেই।
সরকারের নিয়ন্ত্রণ এখানে ততোটুকুই, যতটুকু ধর্মীয় গুরুরা নিচ্ছে। তারা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে হিমশিম খায়, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে, এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সীমিত থাকে। ফলে তারা এক ধরনের শিক্ষাগত সংখ্যালঘুত্বের মধ্যে পড়ে যায়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যখন মূলধারার সমাজে প্রবেশ করতে চায়, তখন তারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের জন্য আলাদা কোটার ব্যবস্থা নেই, অনেক ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এছাড়া, আধুনিক চাকরির বাজারেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা কম সুযোগ পায়, কারণ তাদের শিক্ষা কারিকুলাম এখনও প্রচলিত কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
সংস্কার ও সমাধান
হঠাত করে আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। শক্তহাতে এই মাদ্রাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া দরকার।
কারিকুলাম আপডেট করা: মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইংরেজি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় জেনারেল শিক্ষার মতই অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
কওমি মাদ্রাসার দিকে বিশেষ নজর দেয়া দরকার। নতুন মাদ্রাসা তৈরী করার ক্ষেত্রে নজরদারি করা একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপার।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় অনেক হলেও, শিক্ষাগত কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে তারা এক ধরনের সংখ্যালঘুত্বের শিকার। রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থে শিক্ষার সুযোগকে সবার জন্য সমান করতে চায়, তবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্যও আধুনিক ও মূলধারার শিক্ষার সাথে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজে তাদের শুধু ধর্মীয় শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, বরং দক্ষ জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই প্রকৃত সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: লিয়াকত হোসেন লিমন (লিমন ফকির)
তারিখ: ৩০/০৩/২০২৫
Click here to read this article in English
[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]