মালদার মোথাবাড়িতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মালদা জেলা পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পুলিশের উদ্যোগে পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনো এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
গত ২৭ মার্চ (বৃহস্পতিবার) মালদার মোথাবাড়ি এলাকায় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের দোকান ও বাড়িতে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬০-৭০টি দোকান ও বাড়ি ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, রাস্তায় দলবদ্ধভাবে যুবকদের মিছিল এবং পরবর্তীতে দোকানপাটে আক্রমণের দৃশ্য।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনায় যারা উস্কানি দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ৩৪ জনের মধ্যে কেউ কেউ সংঘর্ষে সরাসরি জড়িত থাকলেও, অন্যান্যদের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, সংঘর্ষের কারণে যাতে নতুন করে উত্তেজনা না ছড়ায়, সে জন্য এলাকায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে ২৫টি সংবেদনশীল এলাকায় পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে। এছাড়া সাতটি মোবাইল ইউনিট এলাকায় টহল দিচ্ছে।
মালদা জেলা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে যে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য অন্যান্য ইউনিট থেকেও অতিরিক্ত বাহিনী আনা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনও কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া হয়নি বা কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি।
সাধারণ মানুষের উদ্দেশে পুলিশের বার্তা স্পষ্ট— তারা যেন কোনও গুজবে কান না দেন এবং প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকেন। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতে ভুয়া খবর না ছড়ানো হয়, সে বিষয়েও পুলিশ সতর্ক করে দিয়েছে।
এদিকে, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব সরব হয়েছে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও পোস্ট করে অভিযোগ করেন যে, মোথাবাড়ি অঞ্চলে হিন্দুদের দোকান, বাড়ি এবং সম্পত্তিতে হামলা চালানো হয়েছে। তার অভিযোগ অনুযায়ী, কমপক্ষে ৬০-৭০টি দোকান লুট করা হয়েছে এবং বহু হিন্দু বাসিন্দা আতঙ্কে রয়েছেন।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, “বৃহস্পতিবার থেকে মালদার মোথাবাড়িতে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ। হিন্দু মন্দির এবং বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। আমি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সাথে কথা বলেছি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছি। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন বাংলায় এই ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”
সুকান্ত মজুমদারের পোস্ট করা যে ভিডিও নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে দেখা যায় কিছু যুবককে ধর্মীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করছেন। তারপরই দেখা যায় রাস্তার পাশে দোকানের ভাঙা শেড। ক্যাপশনে বিজেপি রাজ্য সভাপতি লেখেন, “তোষণসর্বস্ব ব্যর্থ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের হিন্দুদের অস্তিত্ব ক্রমশ আশঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এই ভয়াবহ ছবি আজকের দক্ষিণ মালদহের মোথাবাড়ি অঞ্চলের চৌরঙ্গী মোড়ের।” তিনি আরও লেখেন, “এখনও পর্যন্ত কমপক্ষে হিন্দুদের ৬০-৭০ টি দোকান ভেঙ্গে লুঠ করা হয়েছে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে এবং মূল রাস্তায় দখল নিয়ে যথেচ্ছাচারে গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। এলাকার হিন্দুরা ত্রস্ত, আতঙ্কিত কিন্তু এলাকায় কোনও পুলিশের দেখা নেই! সংখ্যালঘু মুসলিমদের তোষণ করতে করতে রাজ্যের ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী তাঁর গ্রেটার বাংলাদেশ তৈরির গোপন অভিসন্ধি ক্রমশই সফল করে তুলছেন। বাংলার নিপীড়িত অসহায় হিন্দুরা সম্মিলিত হয়ে এই অন্যায় তোষণনীতির প্রতিশোধ নেবেন ২০২৬-এ।”
বিজেপির দাবি অনুযায়ী, এই ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় বিধায়ক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। তিনি সকলকে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবে কান না দিতে সতর্ক করেছেন।
এই ঘটনায় রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও সরব হয়েছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘তোষণমূলক নীতি’ অনুসরণের অভিযোগ এনে বলেন, এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী ‘গ্রেটার বাংলাদেশ’ গঠনের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। তিনি আরও হুঁশিয়ারি দেন যে, আইনানুগ পথে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মালদা জেলা পুলিশ জানিয়েছে যে, তারা নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং আইনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে, সাধারণ নাগরিকদের গুজব বা উস্কানিমূলক প্রচারে প্রভাবিত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও প্রশাসনের সতর্ক নজরদারির মধ্যে মোথাবাড়ি অঞ্চলে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
তারিখ: ২৯ মার্চ, ২০২৫
তথ্যসূত্র: indianexpress, hindustantimes, thewall
Click here to read this article in English