সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি, ধুলিয়ান এবং সামসেরগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সহিংসতা রাজ্যের গোয়েন্দা মহলে গভীর উদ্বেগ ও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংশোধিত ওয়াকফ (Amendment) আইন, ২০২৫-কে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই অস্থিরতা অনেকাংশেই ‘হঠাৎ ঘটে যাওয়া জনরোষ’ নয় বলেই ধারণা গোয়েন্দাদের। বরং, প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এক সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদী ছকের ইঙ্গিত—যার সূচনা হয়েছিল প্রায় তিন মাস আগে।
তিন মাসের ছক এবং সীমান্তপারের যোগাযোগ
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, সংশোধিত ওয়াকফ আইনকে সামনে রেখে একটি নির্দিষ্ট ‘ইস্যু’র অপেক্ষায় ছিল কিছু কৌশলী মহল। আইনটি পাস হওয়ার পরপরই সেই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে উস্কানি এবং সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে কিছু ব্যক্তি অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করে, এবং অনুমোদনহীন মাদ্রাসায় এক মাস ধরে আশ্রয় নিয়ে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে অংশ নেয়। তাদের ভূমিকা সম্পর্কে তদন্ত চললেও, গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কনক্রিট সূত্র হাতে পেয়েছেন।
বিশেষত, জঙ্গিপুর মহকুমা জুড়ে সংঘর্ষের দিন অন্তত ৩০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক কল এসেছিল বলে অভিযোগ। সীমান্তের ওপার থেকে পরিচালিত এই দিকনির্দেশনার মাধ্যমেই কোথায় পুলিশকে আটকে রাখা হবে, কোথায় হামলা চালানো হবে, তা নির্ধারণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙার ঘটনাও এই পরিকল্পনারই অংশ ছিল।
অর্থের উৎস ও ‘পাথর হামলা’র কৌশল
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আর্থিক জোগান আসে বিদেশ থেকেও। প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, তুরস্ক থেকে অর্থ এসেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া, গোয়েন্দাদের মতে, কাশ্মীরের অতীত সহিংসতার কৌশলকেই মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে—যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পরিকল্পিতভাবে পাথর ছোড়া হতো।
মুর্শিদাবাদেও একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। স্থানীয় তরুণদের পাথর ছুঁড়তে প্রতিটি আক্রমণের জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। এই পাথর সংগ্রহ করা হয়েছিল রেললাইনের ধারে থাকা অঞ্চলগুলো থেকে। গত দুই মাস ধরে এই পাথর সংগ্রহ চলে বলে জানা যায়, এবং সেগুলো কিছু বাড়ির ছাদ বা মাদ্রাসার ছাদে গোপনে মজুত রাখা হয়েছিল। এমন কিছু এলাকায় এই পাথরের খোঁজ মিলেছে, যা রেললাইনের একেবারেই বাইরে এবং সাধারণ মানুষের নজরের বাইরে ছিল।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং বক্তব্য
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এক বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “বাংলা জ্বলছে, মুখ্যমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটেছেন।” একইসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন যে রাজ্য সরকার দাঙ্গাবাজদের ‘শান্তির দূত’ হিসেবে তুলে ধরছেন।
যোগী আদিত্যনাথের মতে, দাঙ্গা থামাতে একমাত্র ‘ডান্ডা’ই কার্যকর। হরদইয়ে এক সভায় তিনি বলেন, “দাঙ্গাবাজদের একমাত্র দাওয়াই হল ডান্ডা। আপনারা দেখছেন তো, বাংলা জ্বলছে। মুখ্যমন্ত্রী চুপ করে আছেন।”
এছাড়াও, তিনি হিন্দি ভাষার একটি প্রবাদ ব্যবহার করে বলেন, “লাথো কে ভূত, বাতো সে কাঁহা মাননে ওয়ালে হ্যায়?” যার অর্থ—যারা লাথি খাওয়া ছাড়া বোঝে না, তাদের কাছে কথা বলার মানে নেই।
পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা
১৫ এপ্রিল, ২০২৫ মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে। জেলা পুলিশ, বিএসএফ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর সম্মিলিত উদ্যোগে উপদ্রুত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ ফিরছে। ধুলিয়ান বাজার এলাকায় কিছু দোকান খুলেছে এবং সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে বাইরে বের হতে শুরু করেছেন।
তবে এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাচ্ছে না। বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়ে পড়শি জেলা মালদায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা চলছে। প্রশাসন শান্তি বজায় রাখতে স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় একই ছায়া
মুর্শিদাবাদের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সোমবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে একই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন করে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদের নামে পুলিশের একাধিক মোটরবাইক জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং ব্যাপক সম্পত্তি ক্ষতি হয়। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে।
সংক্ষেপে, মুর্শিদাবাদের সহিংসতার পিছনে যে সংগঠিত ছক ও সীমান্তপারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা নিয়ে গোয়েন্দা মহল উদ্বিগ্ন। এই ঘটনাগুলি শুধুমাত্র স্থানীয় ক্ষোভ নয়, বরং বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অনেকেই মনে করছেন। প্রশাসনের মূল চ্যালেঞ্জ এখন শুধু দোষীদের চিহ্নিত করা নয়, বরং আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সামাজিক সংহতি রক্ষা করাও।
তারিখ: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: hindustantimes
Click here to read this article in English