লক্ষ্মীপুরে মাত্র ৮ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা ছাত্রকে ২৩ সেকেন্ডে ২১ বার বেত্রাঘাত করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। শিশুটিকে শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়ার এই দৃশ্য বৃহস্পতিবার (১৫ মে) ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি প্রকাশের পর অভিযুক্ত শিক্ষক মো. মাসুম পলাতক রয়েছেন, এবং তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
ঘটনাটি ঘটেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের আলীপুর নূরানি হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। ৩৫ সেকেন্ডের ভিডিওটির প্রথম ২৩ সেকেন্ডে ছাত্রটিকে টানা ২১ বার বেত্রাঘাত করতে দেখা যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, শিশুটি কান ধরে আছে, আর শিক্ষক তাকে মারতে মারতে কান ধরে ওঠবস করতে বলেন। শিশুটি ওঠবস করলেও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। ভিডিওটি কে ধারণ করেছে তা নিশ্চিত না হলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, শিক্ষক মাসুম নিজেই অন্য এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে ভিডিওটি করিয়েছেন।
মারধরের শিকার ছাত্রটির নাম রাফি। সে মাদ্রাসাটির হেফজ বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র এবং মধ্য আলিপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের সন্তান।
স্থানীয় ও মাদ্রাসা সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনা ঘটেছে ১২ মে (সোমবার)। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছে এবং পুলিশে অভিযোগ দিয়েছে। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি আজমুল হুদা মিঠু জানান, শিক্ষক মাসুমের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য থানায় যোগাযোগ করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে তিনি মাদ্রাসায় অনুপস্থিত।
লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল মোন্নাফ বলেন, “ভিডিওতে যেভাবে বেত্রাঘাত করতে দেখা গেছে, তা অমানবিক। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে, অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।” গোয়েন্দা পুলিশও এ বিষয়ে তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর মাদ্রাসা এলাকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আইনজীবী, শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভিডিওটি শেয়ার করে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার দাবি করেছেন। নেটিজেনরা এটিকে শিশু নির্যাতনের গুরুতর উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করছেন।
এদিকে, নির্যাতনের শিকার রাফির পরিবারের কেউই এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে, ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর মাদ্রাসাটি বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। রোববার (১৮ মে) পর্যন্ত মাদ্রাসাটি খোলা হয়নি।
একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিশুটি পড়ালেখায় অমনোযোগী থাকায় শিক্ষক মাসুম তাকে শাস্তি দেন এবং নিজেই ভিডিওটি ধারণ করান। তবে ভিডিওটি কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে লক্ষ্মীপুরে শিশুদের নিরাপত্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে, কারণ এই ঘটনার মাত্র দুইদিন আগে, ১৩ মে (মঙ্গলবার), লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের আল মুঈন একাডেমিতে সানিম হোসাইন নামে ২০ পারা কোরআন হিফজ করা ৮ বছর বয়সী অপর এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের ও অভিযুক্ত শিক্ষক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র দাবি করছে, রাফিকে মারধরের ঘটনা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে মীমাংসার চেষ্টা করেছে, যার ফলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হয়েছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রেজাউল হক বলেন, “ভিডিওটি আমার নজরে আসেনি। খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তারিখ: ১৭ মে, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: prothomalo, dhakapost, jagonews24, bdnews24
Click here to read this article in English