টাঙ্গাইলের মধুপুরে হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা পরিষদের বাধার মুখে লালন স্মরণোৎসব কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। গত বুধবার রাত আটটায় মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে এ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে আয়োজক সংগঠন লালন সংঘ ঘোষণা দেয় যে, অনিবার্য কারণে অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।
ধর্মীয় সংগঠনের বাধা ও হুমকি
লালন সংঘের অন্যতম সংগঠক মো. সবুজ মিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক স্ট্যাটাসে জানান যে, হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা পরিষদ মধুপুর শাখার চাপে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
সবুজ মিয়া লিখেছেন, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর লালন সংঘ মধুপুরে দুইবার বৃহৎ পরিসরে লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করে। এ বছরও অনুষ্ঠান সফলভাবে আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল এবং এতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললেও, হঠাৎ করে ইসলামি সংগঠনগুলোর আপত্তির কারণে প্রশাসন ও আয়োজকদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
হেফাজতে ইসলাম ও ওলামা পরিষদের নেতারা লালনের মতাদর্শকে ‘নাজায়েজ, কুফরি ও শিরক’ বলে অভিহিত করে এবং এ ধরনের অনুষ্ঠান মধুপুরে হতে দেবে না বলে ঘোষণা দেয়। বিষয়টি নিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়, যেখানে হেফাজতের নেতারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, তারা লালন চর্চাকে এলাকায় ছড়াতে দেবেন না।
আলোচনার ব্যর্থতা ও অনুষ্ঠান স্থগিতের ঘোষণা
আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলাম মধুপুর শাখার সভাপতি মুফতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মাহমুদুল্লাহ, কওমি ওলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা সোলায়মান কাসেমী ও আরও ১০-১৫ জন ইসলামি নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে, লালন সংঘের পক্ষে সভাপতি ফরহাদ হোসেন তরফদার ও সবুজ মিয়া উপস্থিত ছিলেন। মধ্যস্থতা করেন *মধুপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাকির হোসেন সরকার।
ফরহাদ তরফদার ও সবুজ মিয়া জানান, ইসলামি নেতারা তাদের স্পষ্টভাবে বলেন যে, লালনের মতাদর্শ প্রচার করা যাবে না এবং এ ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। যদিও আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বিতর্কিত কোনো আলোচনা হবে না, তথাপি হেফাজত ও ওলামা পরিষদ নিজেদের অবস্থান থেকে সরেনি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানোর জন্য আয়োজকরা অনুষ্ঠান স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
প্রশাসনের নিরবতা ও দায় এড়ানোর চেষ্টা*
হেফাজতে ইসলাম মধুপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল্লাহ স্বীকার করেছেন যে, তারা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে অনুষ্ঠান বন্ধের দাবি তুলেছেন। কওমি ওলামা পরিষদ মধুপুর শাখার সভাপতি সোলায়মান কাসেমীর মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমরানুল কবির ছুটিতে থাকায় সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেননি। তিনি বলেন, “আজ বুধবার বিকেলে এসে শুনেছি ইসলামি দলগুলো অনুষ্ঠান করতে বাধা দিয়েছে।”
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর্জা জুবায়ের হোসেন বলেন, “দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কোনো পক্ষ বাধা দিয়েছে কি না, সে বিষয়ে আমি অবগত নই।”
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর মৌলবাদীদের ক্রমবর্ধমান হুমকি*
মধুপুরের এই ঘটনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মুক্ত চিন্তার ওপর ক্রমবর্ধমান মৌলবাদী হুমকির একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাউল গানের আসর, পূজা উদযাপন, নাট্যোৎসব ও ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে ইসলামি চরমপন্থীদের হামলা বেড়েছে।
গত কয়েক মাসে দেখা গেছে:
– নরসিংদীতে লালন মেলা বন্ধ করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে।
– সিলেটের শাহ পরানের মাজারে গানবাজনা বন্ধের দাবি তোলা হয়েছে।
– নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে এক মাজারে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।
– কুষ্টিয়ায় লালন একাডেমির একাধিক অনুষ্ঠানে মৌলবাদীরা বাধা দিয়েছে।
এই ধারাবাহিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সংস্কৃতির জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন যে, যদি প্রশাসন এ ধরনের ঘটনায় কঠোর অবস্থান না নেয়, তবে ভবিষ্যতে সাংস্কৃতিক মুক্তির পথ আরও সংকুচিত হবে।
শেষ কথা
মধুপুরে লালন স্মরণোৎসব বন্ধের ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণের অংশ। প্রশাসন যদি ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের চাপে নতি স্বীকার করতে থাকে, তাহলে সাংস্কৃতিক ও মুক্তচিন্তার চর্চা ক্রমেই সংকুচিত হবে।
সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুক্তচিন্তার মানুষদের জন্য এখনই সময় এই মৌলবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার।