ইন্ডিয়ায় একটা বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে গেলো। আমরা মুসলিমরা সেই দুঃখে এখনও কাঁদি। বাংলাদেশে প্রতি মাসে কয়েকটা মন্দির ভাঙা হয়, এতে কি সংখ্যালঘু হিন্দুদের দুঃখ হয় না? আপনার দুঃখটা আসল, অন্যের দুঃখ নকল?
“অন্যের বাপকে জুতার মালা পরাইবেন কিন্তু নিজের বাপের অপমানে বিপ্লবী হইবেন” এই চেতনার নাম’ই কি বাঙালি মুসলিম?
বাংলাদেশে এত মন্দির ভাঙা হয়েছে এবং হিন্দুদের আক্রমন করা হয়েছে যে- ব্যাপারগুলো এখন নরমালাইজড হয়ে গেছে। মনে রাখবেন- এই দেশে আদি বাঙালি, আদি ধর্ম, আমাদের শেকড় কিন্তু হিন্দুই ছিল। তাদের উচ্ছেদ করার মত পাপ প্রাকৃতিক রিভেঞ্জ হয়ে আসবেই।
ধর্মীয় সংঘাত খুবই নিচু মানসিকতার কাজ। অন্য ধর্মের ওপর আঘাত করলে নিজের ধর্মই ছোট হয়।
খিলক্ষেতের মন্দির কি জন্য ভাঙা হয়েছে, সেই যুক্তি দেয়ার আগে আপনি কি বাবরি মসজিদ ভাঙার যুক্তি শুনেছিলেন? এই দেশের হিন্দুরা সব সময় আতংকে থাকে- পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। ইদানিং মুসলিমদের হাতে মাইর খাইতে হিন্দুদের কিছু করতে হয়না। ‘শালা মালাউন’ বলে মাইর দিলেই অন্য মুসলিম ভাইরা হাতে হাত লাগিয়ে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে মাইর শুরু করে দেয়। দেশের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ, পাড়া প্রতিবেশীদের জমি জমা নিয়ে দ্বন্দে থাকে। শুধু মাত্র হিন্দু উচ্ছেদের সময় এদের একতা দেখলে কে বলবে, “এই জাতির মধ্যে এত দ্বন্দ!” হিন্দু নির্যাতনের কথা বললেই একযোগে মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য লোকজন ঝাপিয়ে পরে।
অনেকে বলে সংখ্যালঘু হিন্দুরা চাকরি-বাকরিতে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তারা বেশি সুবিধা পাচ্ছে। পাওয়া কি উচিত নয়? ছোট পরিসরে ব্যাপারটা ভাবেন। আপনার চাচাতো ভাই এতিম, তাকে একটু বেশি সুবিধা দিয়েই প্রমাণ করতে হবে সে আসলে অসুবিধা মোকাবেলা করতেছে না।
পাহাড়িরা, চাকমা, মারমা সহ ছোট সম্প্রদায় এদেরকে অবশ্যই বেশি সুবিধা দিতে হবে। এদের স্ট্রাগল হয়তো আপনি জানেন না। প্রাইমারী স্কুলে আপনারা যে হিন্দুকে আ-কাডা, কাউট্টা নোমো বইলা বুলিং করছিলেন, সেই ব্যাথা কি ভুলিয়ে দিতে হবেনা?
আদতে সংখ্যালঘু হিন্দু, চাকমা, মারমারা- খাতা কলমে বেশি সুবিধার কথা বলা হলেও তারা বেশি সুবিধা পাচ্ছেনা। তারা বেশি বেশি লাঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে।
শৈশব থেকে টিকে থাকার স্ট্রাগল থেকেই তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত করার জন্য চাকরি-বাকরিতে যোগ্যতা দিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চাকরি স্থল থেকে শুরু করে আবাসস্থলে তারা কিন্তু সেফ না।
সাম্প্রতিক সময়ে খুব জোরেশোরে হিন্দু নিধন চলছে, নানা অজুহাতে। যে কেউ বললেই হবে—তারা আমার ধর্মে আঘাত করেছে। ব্যাস… পুঁটি মাছ মারার চেয়ে হিন্দু মারা যেন সহজ! ধর্মের নামে এই অরাজকতার সীমা কোথায়?
২২ জুন, লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি ও তার ছেলেকে আটক করেছে পুলিশ। আটক ব্যক্তিরা হলেন পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীল (৩৫)। শুধু আটক করেও খ্যান্ত হয়নি, তাদেরকে গণহারে মারধোর করা হয়েছে। শুধু মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসনের ভূমিকা ছিল আশ্চর্য হওয়ার মতো। প্রকাশ্যেই প্রশাসনকে পক্ষপাতিত্ব করতে দেখা গেছে।
২৬ জুন বৃহস্পতিবার খিলক্ষেতে রেলওয়ের উচ্ছেদ অভিযানে একটি মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে। রেলওয়ের উচ্ছেদ অভিযানের নামে মন্দির ভেঙে ফেলার জন্য তাদের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। প্রতিমা বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এখানে শুধু মন্দিরের জায়গায় মসজিদ থাকলে দেশে তুলকালাম কান্ড ঘটে যেতো। বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুদের পক্ষে এমন কোন শক্তি নেই যা তাদেরকে নিরাপদে বিচরণ করার সুযোগ দেয়।
২২ জুন, ২৬ জুন এগুলো শুধু তারিখ মাত্র। সংখ্যালঘু নির্যাতন চলে ১২ মাস জুড়েই। রাষ্ট্রের কাছে ধর্মীয় অনুভূতির মূল্য শুধু সংখ্যাগুরুদের ক্ষেত্রে প্রচন্ডভাবে কাজ করে। সেই সুযোগটাই মব সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভাল সুযোগ তৈরী করে। কয়েকটি মন্দির হামলার ঘটনায় সিসিটিভির ফুটেজ থাকার পরে হামলাকারীকে মানসিক রোগী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এবার হামলা করেছে স্বয়ং রাষ্ট্র। অভিযোগ করার’ই কোন উপায় রইলো না।
ওয়াজ-মাহফিলে মাইক লাগিয়ে অন্য ধর্মের লোকেদের কুকুর বলে গালি দিয়ে, মূর্তি-প্রতিমা ভাংচুরের ঘোষণা দিয়ে প্রতিনিয়ত এক দল লোক বিষোদগার করছে। রাষ্ট্র নীরবতার মাধ্যমে তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করলেও অনেক লেখক/ব্লগারদের হয়রানি সহ মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানোর ঘটনাও নতুন নয়। সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বললে সাম্প্রদায়িক উষ্কানির অভিযোগ আনা হয়।
পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ মঙ্গলে পৌঁছে গেছে, কৃত্রিম হার্ট তৈরীর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনও আমাদের ভাবতে হয় মন্দির ভাঙা নিয়ে, লিখতে হয় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে। এক আজব পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে। তারা শিখতেছে নতুন করে, কিভাবে তরবারির ব্যবহার করা যায়। কিভাবে হিন্দু, ইহুদী মেরে সওয়াব কামাই করে জান্নাত নিশ্চিত করা যায়!
লেখক: লিয়াকত হোসেন লিমন (লিমন ফকির)
তারিখ: ২৮ জুন, ২০২৫
Click here to read this article in English
[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]