বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আবারও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া সম্প্রতি ফেসবুকে এক পোস্টে জানিয়েছেন, তিনি গত কয়েকদিন ধরে অব্যাহত ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পাচ্ছেন। এই ভয়ঙ্কর অভিযোগের পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়: কেন সুমাইয়া এই হুমকির শিকার হলেন?
বিতর্কের সূচনা
এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদের মাধ্যমে। ১৮ জন নারী ফুটবলার, যার মধ্যে সুমাইয়াও ছিলেন, অভিযোগ করেন যে বাটলারের কোচিং পদ্ধতি ও মানসিক নির্যাতন তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) চিঠি দিয়ে জানায় যে, বাটলার দায়িত্বে থাকলে তারা কোনো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বা ম্যাচে অংশ নেবেন না। প্রয়োজনে তারা সম্মিলিতভাবে জাতীয় দল থেকে অবসর নিতেও প্রস্তুত।
কিন্তু এই প্রতিবাদের পরপরই ২৩ বছর বয়সী সুমাইয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান, তিনি চরম হুমকির মুখে পড়েছেন।
ন্যায়বিচারের আহবান
ফেসবুক পোস্টে সুমাইয়া লিখেছেন:
“যখন আমি ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, তখন স্বপ্ন ছিল পড়াশোনার বাইরে গিয়ে কিছু করার। আমি চেয়েছিলাম প্রমাণ করতে যে ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম মানুষকে যে কোনো সীমা অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। পরিবার, শিক্ষা, ঈদের আনন্দ—সবকিছু বিসর্জন দিয়েও দেশের জন্য খেলেছি, অথচ সেই দেশ আমাদের কষ্টের মূল্য বোঝে না।”
তিনি আরও লেখেন:
“আমি ফুটবল খেলার জন্য পরিবারকে পর্যন্ত প্রতিপক্ষ বানিয়েছি, ভেবেছিলাম দেশ আমার পাশে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। একজন ক্রীড়াবিদের মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো মূল্য নেই এখানে। গত কয়েকদিন ধরে আমি লাগাতার ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পাচ্ছি। এই হুমকির ভাষা এতটাই ভয়ঙ্কর যে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।”
বাফুফে-এর প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত
সুমাইয়ার অভিযোগের পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এক বিবৃতি প্রকাশ করে:
“জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়ার বিরুদ্ধে হওয়া হুমকি ও হয়রানির ঘটনাকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।”
তবে অনেকে মনে করছেন, এটি শুধুমাত্র জনরোষ সামলানোর একটি কৌশল, প্রকৃত বিচার নিশ্চিত করার কোনো বাস্তব উদ্যোগ নয়।
পিটার বাটলারের পুনঃনিয়োগ ও বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের অবস্থান
এই সংকটের মূল কারণ কোচ পিটার বাটলারের পুনঃনিয়োগ। তার নিয়োগের পরই ১৮ জন খেলোয়াড় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং জানান, তারা বাটলারের অধীনে খেলতে রাজি নন। তাদের মধ্যে ছিলেন অধিনায়ক সাবিনা, মাসুরা ও সানজিদা, যারা যৌথভাবে বাফুফে-এর কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
সুমাইয়া কি প্রতিরোধ আন্দোলনের বলি?
বাফুফে তদন্ত কমিটি বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের প্রশ্ন করে জানতে চায়, প্রতিবাদপত্রটি কে লিখেছিল? সকলেই সুমাইয়ার দিকে আঙুল তোলে এবং তিনিও স্বীকার করেন যে তিনিই এটি লিখেছেন। এর পর থেকেই তার বিরুদ্ধে হুমকির মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
তিনি লিখেছেন:
“আমি জানি না, এই মানসিক আঘাত থেকে আমি কবে সুস্থ হতে পারব। তবে এটুকু জানি, শুধু স্বপ্ন অনুসরণ করায় যেন আর কোনো মেয়ে এমন হুমকির শিকার না হয়।”
পুলিশ অভিযোগ ও আইনি পদক্ষেপ
পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে উঠলে সুমাইয়া অবশেষে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। তিনি ঢাকার মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। বাফুফে-এর মিডিয়া ম্যানেজার খালিদ মাহমুদ নওমী তার সঙ্গে ছিলেন। এই পদক্ষেপটি দেখিয়ে দেয় যে হুমকিগুলো কেবল অনলাইন হয়রানিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার জীবনের জন্য বাস্তব হুমকি তৈরি করেছে।
প্রতিবাদী খেলোয়াড়দের বাদ দেওয়া ও নতুন দল
এই ঘটনার পর কোচ পিটার বাটলার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের জন্য ২৩ সদস্যের নতুন দল ঘোষণা করেন। আশ্চর্যজনকভাবে, যারা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের কেউই এই দলে স্থান পাননি। বাদ পড়া খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সদস্যরাও।
বাটলার দল ঘোষণার সময় বলেন:
“এই দলটি তরুণদের নিয়ে গঠিত। তাদের ভুল হবে, কিন্তু তারাই শিখবে এবং ভবিষ্যতে ভালো খেলবে। আমার লক্ষ্য হলো এমন দল তৈরি করা যারা সঠিক মানসিকতা অর্জন করবে, সম্মান দেখাবে এবং দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।”
বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকট
সুমাইয়ার এই ঘটনা কেবল খেলার জগতের একটি সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবতাকেও সামনে নিয়ে এসেছে। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, বিশেষ করে নারীরা, তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যদি একজন জাতীয় নারী ফুটবল খেলোয়াড়ই নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সাধারণ নারীদের অবস্থা কী?
এই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশে পড়েছে। এটি যেন আরেকটি হারিয়ে যাওয়া গল্প না হয়ে যায়, বরং নারীদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটিই এখন সবচেয়ে জরুরি।
তথ্যসূত্র: যুগান্তর, চ্যানেলআই
তারিখ: ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Click here to read this article in English