ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং চাঁদা আদায়ের উদ্দেশ্যে স্বামীকে আটকে রেখে মারধরের ঘটনায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন, এবং পুরো অঞ্চলজুড়ে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
ঘটনার সূত্রপাত গত শনিবার (২৮ জুন) রাতে, যখন শম্ভুপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রুবেল, যিনি বর্তমানে ঢাকায় একটি হোটেলে কাজ করেন, তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ঝর্ণা বেগমের ডাকে ভোলার তজুমদ্দিনের কামারপট্টি এলাকায় যান। সেখানে পৌঁছানো মাত্রই, আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা কয়েকজন ব্যক্তি তাঁকে আটকে ফেলে এবং চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে, তাঁকে রড, লোহার পাইপ ও হাতুড়ি দিয়ে রাতভর মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
হোটেল শ্রমিক রুবেল টাকা দিতে অপারগতা জানালে তারা তার প্রথম স্ত্রীকে ফোন করে চাঁদার টাকা নিয়ে আসতে বলেন। পরদিন রোববার (২৯ জুন) বেলা ১১টার দিকে মাত্র ১০ হাজার টাকা নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন প্রথম স্ত্রী। হামলাকারীরা তাকে আরও চাঁদা দিতে চাপ দেয়। টাকা দিতে না পারায়, তাঁর সামনেই স্বামীকে আরও একবার ব্যাপক মারধর করা হয়।
এ সময় প্রথম স্ত্রী হামলাকারীদের হাত-পা ধরে স্বামীকে ছেড়ে দিতে বলেন। একপর্যায়ে তাঁরা পাঁচ লাখ টাকার বদলে এক লাখ টাকা দিতে বলেন। তখন প্রথম স্ত্রী তাঁর শ্বশুরকে ফোন করে টাকার জন্য বলেন। টাকা আসছে শুনে-হামলাকারীরা প্রথম স্ত্রীকে ঘরে রেখে স্বামীকে দোকানে চা খাওয়ার কথা বলে বাইরে নিয়ে যান। দুপুর ১২টার দিকে স্বামীকে ঘর থেকে সরিয়ে ফেলে হামলাকারীরা গৃহবধূকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযুক্তরা এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
মামলার অভিযোগপত্রে যেসব ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
মো. ফরিদ উদ্দিন — তজুমদ্দিন উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মো. আলাউদ্দিন — যুবদলের কর্মী। মো. রাসেল আহমেদ — তজুমদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক। মো. সজিব — কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়কএছাড়া, আরও ৬–৭ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গৃহবধূর তৃতীয় স্ত্রী ঝর্ণা বেগমকেও পুলিশ আটক করেছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ
রুবেল ও তাঁর স্ত্রী জানান, ঘটনার পর তাঁদের হুমকি দিয়ে বলা হয় যেন তারা থানায় না যায় এবং বিষয়টি কাউকে জানানো না হয়। পরে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের ফেরেন তিনি। বাড়ি ফিরে গৃহবধূ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দুইবার। পরে প্রতিবেশীদের সহায়তায় তিনি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান।
রোববার রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁদের হেফাজতে নেয় এবং সোমবার রাতে নির্যাতিতাকে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের গাইনি বিভাগে তাঁর চিকিৎসা চলছে বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বক্তব্য
তজুমদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাব্বত খান জানান, গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে ধর্ষণ, চাঁদা দাবি ও মারধরের অভিযোগে একটি মামলা করেছেন। মামলায় মোট ১১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে এক জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, এবং বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশ সুপার মো. শরীফুল হক বলেন, “মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
অভিযুক্তদের পাল্টা বক্তব্য
তজুমদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাসেল আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, তিনি বর্তমানে ঐ এলাকায় থাকেন না এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একইভাবে কলেজ ছাত্রদলের আরেক নেতা জয়নাল আবেদীনও অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি সংগঠনের সভাপতি প্রার্থী হওয়ায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ওমর আসাদ রিন্টু বলেন, “আমরা অভিযোগের বিষয়টি শুনেছি। তদন্তে সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তারিখ: ০১ জুলাই, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: ittefaq, bdnews24, itvbd, dailyjanakantha, somoynews
Click here to read this article in English