June 14, 2025 1:09 pm

উপমহাদেশে হিন্দু নির্যাতনের চিত্র: ৭ দশকে প্রায় ৫ কোটি হিন্দু নিশ্চিহ্নের অপ্রকাশিত ইতিহাস

হিন্দু নিশ্চিহ্নের

বিকাশ মজুমদার: ইসলামিক গণহত্যা আর অত্যাচারে ১৯৪৭ সাল থেকে চলমান সময় পর্যন্ত ৪ কোটি ৯০ লক্ষাধিক হিন্দু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিগত প্রতি দশকের আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে হিন্দু এবং অন্যান্য স্থানীয় সংখ্যালঘু আদিবাসী জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে।

ড. শচী ঘোষ দস্তিদার তার ‘Indian Subcontinent’s Vanishing Hindu and Other Minorities:Empire’s Last Casualty’ গবেষণামূলক বইটিতে দেখিয়েছেন বহু ধর্ম মতের মানুষের পাশাপাশি সহানুভূতিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশে শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে উপমহাদেশের হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালের পর ব্রিটিশ শাসিত উপনিবেশিক ভারত ভাগের পর থেকেই বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানের এই শান্তিপূর্ণ অঞ্চলটিতে স্থানীয় ভূমিপুত্র আদিবাসী, হিন্দুরা তাদের পূর্বপুরুষের বাসভূমি থেকে কীভাবে উৎখাত এবং নিহত হয়েছে সে বিষয়ে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে বইটিতে। দেশভাগের সরাসরি প্রভাব পড়ে হিন্দু এবং সংখ্যালঘু অমুসলিম বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানদের উপর। আঘাত আসে ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং আদিবাসী সংস্কৃতির উপর।

আন্দোলনের মুখে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বঙ্গপ্রদেশ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পূর্ববঙ্গ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা নির্ধারিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের সাথে মিশে গঠিত হয় ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান এবং পরিণত হয় পূর্বপাকিস্তান প্রদেশে। হিন্দু এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচ্ছন্ন মদদে তখন থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরু হয় অসহিষ্ণু ইসলামের ধারাবাহিক নির্দয় ভয়ঙ্কর ধর্মীয় আক্রমণ, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং হত্যাযজ্ঞ। সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রয়ে যায় ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে। এদিকে ক্রমাগত ধর্মীয় আগ্রাসনের কারণে পূর্বপাকিস্তান থেকে হিন্দুরা পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ অর্জন করে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সদ্য জন্ম নেয়া দেশটি পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে আবির্ভুত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান, সৌদিআরবসহ মুসলিম দেশগুলোর গণমাধ্যম বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে প্রমাণ করতে মুসলিম বিভক্তির যুদ্ধ হিসেবে। এমনকি এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী, উর্দুভাষা সমর্থিত গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদেরকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। বাঙালি তাদের যতটা জাতিগোষ্ঠী তার থেকেও বেশী হিন্দু হিসেবে ঘৃণিত ছিল।

ড. শচী ঘোষ দস্তিদার তার বইটিতে বাংলাদেশ থেকে দশক ধরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার শুমারি করেছেন। শুমারি অনুযায়ী ১৯৪৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৭১ বছরে ৪ কোটি ৯০ লাখ হিন্দু জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা থেকেও অধিক। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসেবে শুধু বিএনপি এবং জামায়তে ইসলামের জোট সরকারের শাসনামলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালেই বাংলাদেশে ইসলামীকরণের ধাক্কায় ৩১ লাখ হিন্দু হারিয়ে গেছে।

এত মানুষের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কাহিনী নথিভুক্তি করা নিঃসন্দেহে শ্রম সাধ্য কাজ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপের পদ্মা মেঘনা যমুনা মধুমতী বিধৌত বাংলাদেশ ভুখণ্ড সযত্নে মুছে দিয়েছে সব রক্তের দাগ। ড. শচী ঘোষ দস্তিদার তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে রক্তের দাগ বইয়ের পাতায় আঁচড় কাটলেও পৃথিবীবাসী এই নীরব গণহত্যার বিন্দু বিসর্গ খুব কমই জানে এমনকি এই বাংলাদেশে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী নিজেরাও নিজেদের যন্ত্রণার কথা কোনদিন কোন আলোচনায় মুখে আনেনি। ড. শচী ঘোষ দস্তিদার হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কাহিনী কয়েকটি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করেছেন।

গণহত্যা এবং নিপীড়নঃ

মাত্র কয়েক শতক আগেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আচার, আচরণ, সংস্কৃতি নিয়ে আফগানিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সুখ সমৃদ্ধিতে প্রতাপের সাথে টিকে ছিল। আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, আফগানিস্তান এমনকি ইরানের জাবোল পর্যন্ত হিন্দুদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল।

 

মুহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে আরব সৈন্যবাহিনী ৭১১ সালে সিন্ধু আক্রমণের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে কোন মুসলিম বসতির অস্তিত্ব ছিল না। একের এক আক্রমণের মুখে হিন্দুরা আজকের আফগানিস্তানে ৯৮৭ সালে মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয় এবং বর্তমানের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মুসলিমদের হস্তগত হয় ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে পাকিস্তান নিজেদের দেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা দেয়।

AP1GczN6WiGI8UQaZs6Bwmng7i8SSN1S2eS3 cxpS282NGIhSO8LFZjHZcvnW1 Ciw6JgG7IJykJG8VwH4rEj HtkiO pQBxZrhF6mTogYOg9v0 nL IZxSWcm4vUJmwyJjQQjQjfKGz288b9hy7IPx9DfU=w475 h633 s no gm?authuser=1
বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে লেখক

পাকিস্তান ছিল পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান নামের দুই ভূখণ্ডে বিভক্ত। মাঝখানে ২২০৮ কিলোমিটারের দূরত্ব। শুধু ধর্মের মিলের কারণে সমস্ত সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যকে অস্বীকার করে এমন অদ্ভুত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু ধর্মভিত্তিক কাঠালের আমসত্ত্ব বেশিদিন টেকেনি পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত মুসলিমদের শাসন আর শোষণের কাছে। অভিজাত মুসলিম শ্রেণির শোষণ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আস্তে আস্তে সেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের দিকেই ঝুঁকছে আজকের বাংলাদেশ। যদিও জন্মের পরে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু সেই অসাম্প্রদায়িক শ্লোগান এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রহসন আর মিথ্যাচার এবং অসাম্প্রদায়িকতা এখন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের রাষ্ট্রীয় মাধ্যম।

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেই হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু নাগরিকেরা শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হুমকি এবং বৈষম্যের শিকার। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তানে ২৪ শতাংশ হিন্দুর বসবাস থাকলেও সেসব অনেক দুরের গল্পকথা বর্তমানে আছে অল্প মানে মাত্র দুই শতাংশেরও কম।অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শ্লোগানের বাংলাদেশের অবস্থাও পাকিস্তানের মত তথৈবচ। ১৯৪৭ সালে দুই পাকিস্তানের একত্রে বসবাসের সময় এখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণ ছিল ৩১ শতাংশ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক আদর্শে সেই সংখ্যা এখন ৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন আগামী ৫০ বছরে হয়ত বাংলাদেশ হিন্দু শূন্য হবে।

পক্ষান্তরে, অবাক কাণ্ড হলো ভারতে ১৯৪৭ সালের তুলনায় বর্তমানে মুসলিম জনসংখ্যা অধিকহারে বেড়েছে। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয় দেশ থেকেই সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধদেরকে সম্প্রাদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে, বসভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, নিয়মিত বিরতিতে হত্যা করা হয়েছে অথবা জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে কিন্তু কোনদিন কোন গণমাধ্যমে এইসব সংবাদ প্রকাশ পায়নি। এসব ঘটনা দিনের আলোতে বা রাতের অন্ধকারে যেভাবেই ঘটুক না কেন রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি ওয়াকিবহাল থাকলেও নীরব দর্শক ছাড়া তার কোন ভূমিকা ছিল না। শুধু নেই কোথাও কোন প্রতিবাদ।

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে কোনদিন জবাবদিহি করতে হয়নি এই বিপুল হিন্দু জনগোষ্ঠী কীভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বা দেশটি তাদের সাথে কী করেছিল। পাক-বাংলা ভূমিতে হিন্দুরা জীবন জীবিকা ও সম্পদের চিরস্থায়ী হুমকির মধ্যে বসবাস করে। পাকিস্তান বাংলাদেশ দুইদেশেই প্রচুর মন্দিরকে জোর করে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে এমন মন্দিরের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। হিন্দুর ফসলিজমি, বসতভিটা, মন্দিরের সম্পত্তি অবৈধ জবর দখল, হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটতরাজ, হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য, হত্যা, হিন্দু নারীদের যৌনহয়রানি, ধর্ষণ, যুবতি হিন্দু মেয়েদের অপহরণ এদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের হিন্দুরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের যোগসাজশে বিপুল গণহত্যার শিকার হয়। প্রতিবেদনে প্রকাশ ঐ সময়ে প্রায় ২০ লাখ হিন্দু জনগোষ্টীকে হত্যা করা হয়। একই সময়ে বিপুল পরিমাণ হিন্দুনারী অপহরণ এবং ধর্ষণের শিকার হন।

ড. শচী ঘোষ দস্তিদারের Empire’s last casualty: Indian subcontinent’s vanishing Hindu and other minorities বইটিতে দেখানো হয়েছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই সলামিকরণ প্রক্রিয়ায় শুধু বাংলাদেশেই ৩০ লাখ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়েছে। এই ৩০ লাখ হিন্দুর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া পৃথিবীবাসীর কাছে অজানা খবর। এমনকি বর্তমানেও প্রতিদিন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও হিন্দুরা নীরব গণহত্যা, সন্ত্রাসী আক্রমণ, বিচ্ছিন্ন হত্যা, হেনস্তা এবং উগ্র নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত হিন্দুবিচারক, বিভিন্ন পেশাজীবী, শিক্ষক, আইনজীবী এবং সরকারী কর্মকর্তাদেরকে লক্ষ্য করে হত্যা করা হয় যাতে তারা প্রতিবাদটুকুও করতে না পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত মানবাধিকার সংস্থাগুলো চোখে কাঠের চশমা পরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখেছে।

ধর্মান্তরকরণ এবং জোরপূর্বক বিয়েঃ

দেশভাগের পরপরই যুবতী হিন্দুমেয়েদের অপহরণ করে জোর করে বিয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যায়। পাক-বাংলার মূলধারার গণমাধ্যমে হয়ত কালেভদ্রে সেইসব খবর ছাপা হতো। অথচ ভারতের গণমাধ্যম হিন্দুমেয়েদের অপহরণের খবরে বিস্ময়করভাবে নীরব ভূমিকা পালন করে এবং বেমালুম চেপে যায়। প্রতিটি ঘটনার ভয়াবহতা আর ব্যপ্তি কত ন্যাক্কারজনক ছিল তার একটা উদাহরণ দিলে হয়ত সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডন’ পত্রিকায় ২০০৫ সালের ৩ নভেম্বরে ছাপা হয় করাচির পাঞ্জাব কলোনি থেকে ১৯জন হিন্দুমেয়ে তাদের নিজেদের এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। নিখোঁজ মেয়েদের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন বুঝতে পারেন মেয়েগুলোকে অপহরণ করে তাদেরকে ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা হয়েছে।

২০০৫ সালের অক্টোবরে তিনটি হিন্দুমেয়ের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ঘটনাকে উপজীব্য করে দ্য ডন পত্রিকার কলাম লেখক ইরফান হুসাইন ২০০৫ সালের ৩ ডিসেম্বর “Conversion Losses” শিরোনামে একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখেন। করাচি শহরের এক হতভাগ্য হিন্দু বাবামা’র করুণ কাহিনী তুলে ধরেন তিনি। ২০০৫ সালের অক্টোবরে তিনটি বিবাহযোগ্য রীনা, উষা এবং রিমা নামের তিনটি হিন্দুমেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়।

কয়েকদিন পরে হতভাগা পরিবারের কাছে তিনটা কুরিয়ারের প্যাকেট এসে পৌঁছায়। প্যাকেটের মধ্যে পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া মেয়ে তিনটির ধর্ম পরিবর্তনের ঘোষণাপত্র এবং সেখানে লেখা আছে “মেয়েগুলো ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে এবং সেজন্য তারা তাদের হিন্দু বাবামায়ের সাথে আর বসবাস করতে পারবেনা। “ঘোষণাপত্র পড়ে তাদের পরিবারের কান্না ছাড়া আর কীইবা করতে পারত! মেয়ের বাবা বললেন, “আমরা শুধু একে অপরেরদিকে তাকিয়ে ঠাই বসে ছিলাম এবং এখানেই আমাদের জীবন সমাপ্ত হয়ে গেছে।” বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে এরকম হতাশাজনক অবস্থা যেকোন সময় যেকোন হিন্দু পরিবারের উপর নেমে আসতে পারে।

অপহরণ এবং হত্যাঃ

এমনকি গত কয়েক মাসেও কয়েক হাজার হিন্দু পরিবার বাংলাদেশ থেকে ভিটে মাটি ছেড়ে প্রাণের ভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অপহরণ, গুম, সম্পত্তি ও ব্যবসা জোর করে দখল, জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তর পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে নীরবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অলিখিত ছত্রছায়ায়। অপহরণ করা হয় বেশিরভাগ সময় মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটা উদাহরণ দিই, পাকিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতা সতিশ আনন্দকে করাচিতে গুম করে তার পরিবারের কাছে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবী করা হয় এবং মুক্তিপণ দিয়েই সে অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তি পায়। ২০০৯ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের কারজায় অঞ্চলের শিখ সম্প্রদায়কে জিজিয়া কর হিসেবে পঞ্চাশ মিলিয়ন রুপী দিতে বাধ্য করা হয়।

জিজিয়া করের ভুক্তভোগীরা কর দিতে না পারলে তাদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠন করে আগুন জ্বালিয়ে দিতো। উচ্চ হারের কর থেকে রক্ষা পেতেও সেই সময়ে বিপুল পরিমাণ হিন্দু ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। জিজিয়া কর ইসলামের জন্মের পর থেকেই ঐতিহাসিক লিগাসি। মুহম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু জয় করে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করে দেয়। শরিয়া আইন চালু করে অমুসলিমদের ধর্ম পালন এবং লাগরিক সুরক্ষার নামে অতিরিক্ত কর আরোপ করে এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উপর অধিকহারে কর বোঝা চাপিয়ে দেয়।

বৈষম্য এবং দখলদারিত্বঃ

বৈষম্য জিনিসটা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে হিন্দুদের জন্য সামাজিক এবং রাস্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এবং সেটা আইনানুগভাবে প্রয়োগ হয়। সংবিধানানুসারে কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক এই দুটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে না। রাষ্ট্রপ্রধান হবেন শুধু একজন মুসলিম। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালে শত্রু সম্পত্তি নামের অদ্ভুত আইন তৈরি করে। দেশভাগের সময়ে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি রাতারাতি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়। শত্রু সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে হিন্দুদের জমিজমা, মন্দির দখল করা আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শত্রু সম্পত্তির নাম পাল্টে অর্পিত সম্পত্তি করা হয় কিন্তু প্রয়োগ থেকে যায় সেই আগের মতই। নতুন আইনে রাষ্ট্র নিজেই হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিকে পরিণত হয়। অর্পিত সম্পত্তি আইনের খাড়ার তলে হিন্দুরা হারায় তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি, লক্ষ লক্ষ একর কৃষিজমি। অর্পিত সম্পত্তি আইনের সাহায্যে সরকার হিন্দুদের জমিজমা অধিগ্রহণ করে মুসলিমদের মাঝে বিলিয়ে দেয়।

মুক্তির পথ খুঁজতে মৃত্যুর মুখেঃ

ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক অত্যচার, হত্যা এবং বিতাড়নে উদ্বিগ্ন হয়ে ১৯৫০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একটা সমঝোতা চুক্তি আবদ্ধ হন এবং দুই দেশের সরকার তাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা, তাদের ধর্মীয় এবং ব্যক্তিজীবনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন। চুক্তিতে দুই দেশের নেতার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখা গেলেও তৎকালীন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু ধর্মী সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার নিপীড়ন কিছুই কমে না বরং বছর বছর বাড়তে থাকে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার নতুন মাত্রা পায়। কিন্তু ভারতে এই বিষয়ে আশ্চর্য নিরবতা অবলম্বন করে।

ভারতের চোখের সামনে প্রতিবেশী দুই দেশে নীরব হিন্দু গণহত্যা এবং বিতাড়ন চলতেই থাকে। ভারতীয় সরকারের নৈতিক এবং আইনি দ্বায়িত্ব ছিল নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র মোতাবেক বাংলাদেশ এভং পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদেরকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার তাগিদ দেয়া। ভারতের উচিৎ ছিল বাংলাদেশ সরকারের অধিকৃত হিন্দুদের জন্মি হিন্দুদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করা। চলমান পরিস্থিতি প্রশমিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এগিয়ে আসা দরকার। হিন্দুদের উপর অত্যাচার নির্যাতন অস্বীকার করা স্পষ্টতই ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী।

পাকিস্তান আর বাংলাদেশি হিন্দুদের শুধু অত্যাচারের সুখভোগ করার এবং মুখবুজে সব সহ্য করার অধিকার আছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উপর অত্যাচার, নিপীড়নের খবর ভারত মুলধারার গণমাধ্যমে কোনদিন প্রকাশ পায়নি। ভারত এক্ষেত্রে হিন্দুদের করুণ পরিণতি দেখেও সেক্যুলারিজমের তকমা গায়ে লাগিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে নির্দয়ভাবে নীরব থেকেছে। এমনকি খোদ ভারতেও মুসলিম যুবকের হাতে হিন্দুমেয়ে ধর্ষণ হলে খবরটা সেক্যুলারিজমের চাদরে ঢাকা পড়ে যায় কিন্তু একজন মুসলিম মেয়ে ধর্ষণের শিকার মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যানার হেডলাইনে প্রচারণা পায়, দেশব্যপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দেশের আইন কি শুধু ধর্মীয় সন্ত্রাসী, দেশবিরোধী আর অত্যাচারীদের সুরক্ষার জন্য? মৌলিক এবং মানবিক অধিকার কি শুধু তাদের জন্য সংরক্ষিত? ভারত কি কখনো উপমহাদেশের হিন্দু নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসবে? উপমহাদেশ থেকে ইসলামপন্থী জিহাদিদের দ্বারা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার অসমাপ্ত কাহিনীর মঞ্চায়ন চলছে। ইসলামের শান্তির ছায়াতলে হারিয়ে যাচ্ছে দর্শন চর্চার জন্মস্থান আর ভাববাদী মানুষ।

তথ্যসূত্রঃ
• 49 Million Hindus Missing From Bangladesh Census due to Islamic atrocities :: Vanishing Hindu and other India root minorities from Indian subcontinent.
• Poliitical Economy of Khas Land in Bangladesh by Abul Barakat

লেখকঃ বিকাশ মজুমদার
মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী
নিউইয়র্ক, ইউএসএ

তারিখ: ২৮ মার্চ, ২০২৫

Click here to read this article in English

আরো খবর পড়ুন

[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

চৌগাছা উপজেলায় ৭ বছর
শিশু

যশোরের চৌগাছা উপজেলায় ৭ বছর বয়সী শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার, গ্রেফতার ১

যশোরের চৌগাছা উপজেলায় মাত্র ৭ বছর বয়সী এক শিশু তারই প্রতিবেশীর দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার (১১

Read More »
দলিত সম্প্রদায়ের 
ধর্ম

নেত্রকোনায় খাসজমিতে বাস করা দলিত সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙচুর

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা বাজার সংলগ্ন একটি সরকারি খাসজমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা দলিত সম্প্রদায়ের পাঁচটি পরিবারের ঘরবাড়ি সম্প্রতি একাধিক দফায়

Read More »
ইউটিউবার 'এস এ সাব্বির'
অন্যান্য

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ইউটিউবার ‘এস এ সাব্বির’ গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী

সরকারের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণভিত্তিক ভিডিও প্রকাশের জেরে ইউটিউবার এস এ সাব্বির কাশিমপুর কারাগারে বন্দি। সরকারি ঘনিষ্ঠ মহলের দায়ের করা মামলায় তাঁকে

Read More »
বান্দরবানে ম্রো শিশুর
শিশু

বান্দরবানে ম্রো শিশুর ওপর নৃশংস নির্যাতন: ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক

বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ১২ বছর বয়সী এক ম্রো কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ

Read More »
প্রতিমা ভাঙচুর
ধর্ম

বরিশালের গৌরনদীতে প্রতিমা ভাঙচুর: পালানোর সময় কিশোর আটক

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার জঙ্গলপট্টি গ্রামে একটি হিন্দু পরিবারের বাড়ির মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এক কিশোরকে আটক করেছে স্থানীয় জনতা। বুধবার

Read More »
মন্দিরে ভয়াবহ হামলা
ধর্ম

সীতাকুণ্ডে মন্দিরে ভয়াবহ হামলা: প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে উদ্বেগ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর গ্রামে একটি হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সর্বজনীন শ্রীশ্রী

Read More »
Scroll to Top