দিনাজপুর সদর উপজেলার বনতারায় এক হিন্দু তরুণের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, ২৪ বছর বয়সী সবুজ দাস ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। এই ঘটনায় স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তারা দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে তার গ্রেপ্তারের দাবি জানায়।
এদিকে, সেই পোস্ট শেয়ার করার অভিযোগে এক স্কুল শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ওসি মতিউর রহমান জানান, ঘটনার দুই দিন পর, রবিবার ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষক উপেন চন্দ্র রায় বনতারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মামলার মূল অভিযুক্ত ২৪ বছরের সবুজ দাস, যিনি বনতারা গ্রামের কমল দাসের ছেলে এবং ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।
মামলায় বলা হয়েছে, ১ এপ্রিল সবুজ দাস তার ফেসবুক আইডি থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন, যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আরও বলা হয়েছে, বনতারা গ্রামের চারপাশে ভারতের সীমান্ত থাকায়, এই পোস্ট রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার স্থানীয়রা দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেয়া হয়।
এরপর থেকেই শংকরপুর ইউনিয়নের মহনপুর, বনতারা ও আশপাশের এলাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সবুজ দাসকে প্রধান আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন তসলিম উদ্দিন সরকার নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা।
ওসি মতিউর রহমান জানান, সবুজ দাসের পোস্ট শেয়ার করার জন্য শিক্ষক উপেন চন্দ্র রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর সবুজ দাসকে ধরতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বনতারার হিন্দু পরিবারগুলোকে অবরোধ করে রেখেছে এলাকার মুসল্লিরা। তৌহিদী জনতা ঘোষণা দেয় সবুজ দাস গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত হিন্দুদের দোকানপাট খোলা যাবেনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় তৌহিদী জনতা হিন্দুদের দোকান খোলা পেলে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়, পাশাপাশি কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভ্যান-রিকশাওয়ালা যেন তাদের ভ্যান/রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে সে ব্যাপারেও হুশিয়ারি দেয়া হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হিন্দুরা, তাদের আয়ের একমাত্র উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারসহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে জানা যায়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা নতুন নয়। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক হামলা হয়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে সংখ্যালঘুদের উপর ২,০১০টি হামলার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৬৯টি মন্দিরও রয়েছে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুলনায় ১৫ বছর বয়সী এক হিন্দু কিশোরকে ফেসবুকে মহানবী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে পুলিশ স্টেশনের ভেতরেই মারধর করা হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, বিশেষ করে ৫৭ ধারার অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এই ধারাটি অনলাইনে প্রকাশিত কোনো তথ্য যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। এই আইনের আওতায় অনেক সাংবাদিক, ব্লগার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
দিনাজপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতপ্রকাশের সীমা নিয়ে বিতর্ক চলমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তারিখ: ০৯ এপ্রিল, ২০২৫
তথ্যসূত্র: ajkalerkhobor, bdnews24
Click here to read this article in English