বাংলাদেশের যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলায় এক রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই প্রাণ হারাননি—তার রেশ গিয়ে পড়েছে একটি নিরীহ হিন্দু পল্লির ওপর। কৃষক দল নেতা এস এম তরিকুল ইসলামকে হত্যার পরপরই যেসব ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়, সেগুলোর সবই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের। স্থানীয়দের দাবি, তারা এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তবুও পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে।
হত্যাকাণ্ড ও ঘটনার সূচনা
বৃহস্পতিবার (২২ মে) সন্ধ্যায় অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে মাছের ঘের লিজ সংক্রান্ত আলোচনায় যোগ দিতে গিয়ে নিহত হন কৃষক দলের নওয়াপাড়া পৌর শাখার সভাপতি এস এম তরিকুল ইসলাম (৫০)। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে আলোচনা চলাকালে ৭-৮ জন অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত সেখানে ঢুকে তরিকুলকে প্রথমে কুপিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। তার মরদেহ ঘটনাস্থল থেকেই উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহতের পরিবারের দাবি, তরিকুলকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মাথায় গুলি করার পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক হাত বিচ্ছিন্ন করা হয়, এমনকি মাথায় ইট দিয়ে আঘাতও করা হয়।
সহিংস প্রতিক্রিয়া: আঘাত হানে মতুয়া পাড়ায়
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে। বিক্ষুব্ধ জনতা প্রথমে পিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর পিন্টুর বাড়ির পাশের ১৩টি হিন্দু পরিবারের ১৮টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সব ঘরই ছিল মতুয়া সম্প্রদায়ের, যারা একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।
ক্ষতিগ্রস্তদের ভাষ্য মতে, আক্রমণকারীরা দলবেঁধে এসে ঘরে ঢুকে লুটপাট চালায়, ভাঙচুর করে এবং এরপর ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আতঙ্কিত বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। অনেকেই জানান, তারা দূর থেকে দেখেছেন তাদের সারা জীবনের সঞ্চয়, ধানের গোলা, গৃহস্থালির আসবাবপত্র, রান্নাঘর, টিভি, ফ্রিজ, যানবাহন—সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে।
নিঃস্ব মানুষের কান্না
চন্ডিকা বিশ্বাস বলেন, “আমাদের দুটি বাড়ি একেবারে পুড়ে গেছে। আমার শাশুড়ি অসুস্থ অবস্থায় পোড়া মেঝেতে পড়ে আছেন। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই।”
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমরা কী অপরাধ করেছি? আমরা তো শুধু হিন্দু মতুয়া, কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তাহলে আমাদের ঘর পুড়লো কেন?”
আরেক বাসিন্দা স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, “ঘটনার রাতে ছেলে, ছেলের বউ আর স্বামীকে নিয়ে পাশের গ্রামে পালিয়ে যাই। হামলাকারীদের অনুরোধ করেছিলাম—যা কিছু আছে নিয়ে যাও, আগুন দিও না। তবুও তারা লুটপাট করে আগুন লাগায়। আগুনে শুধু ঘর না, আশেপাশের গাছের পাতাও পুড়ে গেছে।”
শংকর বিশ্বাস বলেন, “আমরা হিন্দু, মতুয়া—তাই কি আমাদের এত বড় মূল্য দিতে হলো? আমরা চাই বিচার হোক, যারা নিরীহদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।”
প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও তদন্ত
অভয়নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুল আলীম জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সন্দেহভাজন দুই যুবককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, “ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তদন্ত শেষ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে।”
বিদ্যুৎহীন পাড়া, পুরুষশূন্য পরিবার
ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের মতুয়া পাড়াটি বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। অধিকাংশ বাড়ির পুরুষ সদস্যরা নিরাপত্তার অভাবে গ্রাম ছেড়েছেন। অনেক পরিবার আজও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। আত্মীয়স্বজনেরা খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ছুটে আসছেন, কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি।
পরিদর্শন ও মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন যশোর জেলার বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা এবং পুলিশ সুপার রওনক জাহান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় নেতারাও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সংখ্যালঘু মতুয়া সম্প্রদায়ের ওপর এমন সহিংসতার স্বাধীন তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে।
তরিকুল ইসলামের নির্মম হত্যাকাণ্ড যেমন দুঃখজনক, তেমনি পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় মতুয়া সম্প্রদায়ের নিরীহ হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর সহিংস আক্রমণ এবং তাদের ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া এক গভীর মানবাধিকার সংকটের ইঙ্গিত দেয়।
তারিখ: ২৪ মে, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: kalerkantho, prothomalo, somoynews
Click here to read this article in English