June 14, 2025 12:33 pm

ইরান থেকে বাংলাদেশ: নারী স্বাধীনতার সংকট ও শরিয়া আইনের ভয়াবহ পরিণতি

থেকে বাংলাদেশ

ইরান একসময় নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম অগ্রসর দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর চিত্র পুরোপুরি বদলে যায়। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নারীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

খোমেনীর ক্ষমতায় আসার আগে নারী স্বাধীনতার এক স্বর্ণযুগ ছিলো। ১৯২৫ সালে রেজা শাহ পাহলভি এবং পরে তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে ইরানে নারী স্বাধীনতা ক্রমাগত উন্নত হচ্ছিল। বিশেষ করে ১৯৬৩ সালে চালু হওয়া “হোয়াইট রেভল্যুশন” এর মাধ্যমে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয় এবং তারা সরকারি ও বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ পায়।

১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ছিল নারী। নারীরা চিকিৎসা, আইন, প্রকৌশলসহ বিভিন্ন পেশায় কাজ করার সুযোগ পেতেন। অনেক নারী সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী ও রাজনীতিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তখন ইরানে নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা ছিল না, নারীরা পশ্চিমা ফ্যাশন অনুসরণ করতে পারতেন। হিজাব পরা বা না পরা নারীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করত। নারীরা স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারতেন। পারিবারিক আইন ও বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে নারীদের কথা বিবেচনা করে করা হয়েছিলো। বিবাহবিচ্ছেদ ও সন্তানের দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রেও নারীদের অধিক ক্ষমতা ছিল। বহু বিবাহ নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল এবং নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। খোমেনীর নেতৃত্বে নতুন ইসলামি সরকার শরিয়া আইনকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, যা নারীদের অধিকারের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

১৯৮০ সালের দিকে বাধ্যতামূলক হিজাব আইন কার্যকর করা হয়। নারীদেরকে সর্বদা মাথা ও শরীর ঢেকে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। হিজাব না পরার শাস্তি হিসেবে অর্থদণ্ড থেকে শুরু করে কারাদণ্ড পর্যন্ত আরোপ করা হয়। নারীরা যদিও শিক্ষার সুযোগ পেতেন তবে তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। কর্মসংস্থানে নারীদের উপস্থিতি কমানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পুরুষদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়। নারীদের সাক্ষ্যের মূল্য পুরুষদের সাক্ষ্যের তুলনায় কম বলে বিবেচিত হয়।

উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে পুরুষদের অধিক সুবিধা দেওয়া হয়। বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইনে পুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নারীরা একা ভ্রমণ করতে বা কোনো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বিদেশ যেতে পারেন না। বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। পুরুষ অভিভাবকত্ব আইন নারীদের উপর আরোপিত হয়, যার ফলে তারা স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

ইরানে নারীদের অবস্থা ১৯৭৯ সালের আগে ও পরে দুই বিপরীত চিত্র দেখা যায়। একসময় যেখানে নারীরা শিক্ষায়, কর্মসংস্থানে ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকারের ব্যাপক অবনতি ঘটে। বহু বছর ধরে নিপীড়িত হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে নারীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে নারীদের অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের পর থেকে নারীরা বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছে। “হোয়াইট ওয়েনসডে” আন্দোলন শুরু হয়, যেখানে নারীরা বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর গণআন্দোলন শুরু হয়, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

487721186 122119411532794668 2138610018819697115 n.jpg? nc cat=102&ccb=1 7& nc sid=127cfc& nc ohc=pwHjMwcEPZwQ7kNvgF09Z7C& nc oc=Adk1yCw7yLwG1k9miD9VrLN8pSbgoFh3tcVTGM2qijWdEr4c2UEfeLUOEq5uvypPtvk& nc zt=23& nc ht=scontent.fktm20 1

ইরানে নারীদের ১৯৭৯ সালের আগে ও পরের অবস্থা নিয়ে লেখার কারণ হচ্ছে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অবস্থা। বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা দেখেছি পোশাকের জন্য হেনস্তার শিকার হচ্ছে প্রচুর নারী। রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে নারীদের পেটানো হয়েছে। সমুদ্রের ধারে একা ঘুরতে যাওয়ার জন্য মারধোর করা হয়েছে। রোজার মাসে পর্দা না করার জন্য নারীকে বাসে উঠতে বাধা দিয়েছে। লাঠি হাতে প্রকাশ্যে সকল ধর্মের নারী ও শিশুকে পর্দা না করার কারণে ভয় ভীতি দেখানো এবং ধর্ষণে হুমকি দেয়া হয়েছে। নারী হেনস্তা করা আসামিকে হুজুররা যেয়ে মব করে ছাড়িয়ে এনেছে এবং নারী হেনস্থাকে উৎসাহিত করেছে। এছাড়া সারাদেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, খুন সহ সকল নারী সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ একটি বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যগতভাবে বৈচিত্র্যময় দেশ। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতা গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশে নারী অধিকার ও স্বাধীনতার উন্নতির পেছনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, বিশেষ করে গার্মেন্টস খাত, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশাসনে। তাছাড়া নারীরা রাজনীতি, ব্যবসা ও উদ্যোক্তা খাতেও সফলভাবে কাজ করছে।

 

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনসহ বেশ কিছু আইন নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। সমাজে নারীদের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। নারীরা পোশাকের ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীনতা ভোগ করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক ও ধর্মীয় চাপে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে বাধ্য হতে হয়। বিচারব্যবস্থা ধর্মীয় নয় বরং নাগরিক আইন দ্বারা পরিচালিত হয়।

যদি বাংলাদেশে শরিয়া আইন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা নারীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। শরিয়া আইন অনুসারে নারীদের সাক্ষ্যের মূল্য পুরুষদের তুলনায় কম বিবেচিত হবে। পারিবারিক আইনে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, বিশেষ করে বিবাহ, তালাক ও সম্পত্তির ক্ষেত্রে। উত্তরাধিকার আইনে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম সম্পত্তি পাবেন। নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব বা বোরকা পরতে হবে। পাবলিক স্পেসে নারীদের চলাচলের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ হতে পারে। যেমন- নারীরা মাহরাম ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে পারবে না।

কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে কাজ করায় নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। শরিয়া ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত হলে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ কমে যেতে পারে। তখন নারীদের হিসাব করার মতো শিক্ষা গ্রহণ করলেই চলবে। সেক্ষেত্রে নারীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারাবে। শরিয়া আইনের কঠোরতা থাকলে অনেক কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে। নারীরা ব্যবসা, ব্যাংকিং পরিষেবার সুযোগ হারাবে। স্বনির্ভর নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নানান প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ সহজতর করা হতে পারে, যা নারীদের পারিবারিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করবে। নারীদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদ আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী শাসন তথা শরিয়া আইন বাস্তবায়নের আহ্বান এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ঘটেছে, যা চিন্তার বিষয়। যদি বাংলাদেশে শরিয়া আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা ঠিক ইরানের মতই হবে। বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতা যতটুকু অর্জন হয়েছে তার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা শরিয়া আইনের কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধবংস হয়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের নারী পুরুষ নির্বিশেষে শরিয়া আইন চাচ্ছে।

যদি শরিয়া আইন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়, তবে নারীরা স্বাধীনতা হারাবে। শরিয়া আইন সম্পর্কে অবগত কোনো স্বাধীনচেতা নারী কখনোই শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত হোক তা চাইবে না। তাই বাংলাদেশের নারী স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদেরই উপর। হয়ত এখনো সময় আছে। আমাদের সকলের উচিত শরিয়া আইন সম্পর্কে জানার, বোঝার। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়ার আমরা সত্যিই ইসলামী শাসন তথা শরিয়া আইন চাই কি না!

লেখক: তানজিয়া রহমান
নারীবাদী লেখক ও এক্টিভিস্ট

তারিখঃ ১ এপ্রিল, ২০২৫

Click here to read this article in English

আরো খবর পড়ুন

[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

চৌগাছা উপজেলায় ৭ বছর
শিশু

যশোরের চৌগাছা উপজেলায় ৭ বছর বয়সী শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার, গ্রেফতার ১

যশোরের চৌগাছা উপজেলায় মাত্র ৭ বছর বয়সী এক শিশু তারই প্রতিবেশীর দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার (১১

Read More »
দলিত সম্প্রদায়ের 
ধর্ম

নেত্রকোনায় খাসজমিতে বাস করা দলিত সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙচুর

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা বাজার সংলগ্ন একটি সরকারি খাসজমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা দলিত সম্প্রদায়ের পাঁচটি পরিবারের ঘরবাড়ি সম্প্রতি একাধিক দফায়

Read More »
ইউটিউবার 'এস এ সাব্বির'
অন্যান্য

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ইউটিউবার ‘এস এ সাব্বির’ গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী

সরকারের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণভিত্তিক ভিডিও প্রকাশের জেরে ইউটিউবার এস এ সাব্বির কাশিমপুর কারাগারে বন্দি। সরকারি ঘনিষ্ঠ মহলের দায়ের করা মামলায় তাঁকে

Read More »
বান্দরবানে ম্রো শিশুর
শিশু

বান্দরবানে ম্রো শিশুর ওপর নৃশংস নির্যাতন: ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক

বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ১২ বছর বয়সী এক ম্রো কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ

Read More »
প্রতিমা ভাঙচুর
ধর্ম

বরিশালের গৌরনদীতে প্রতিমা ভাঙচুর: পালানোর সময় কিশোর আটক

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার জঙ্গলপট্টি গ্রামে একটি হিন্দু পরিবারের বাড়ির মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এক কিশোরকে আটক করেছে স্থানীয় জনতা। বুধবার

Read More »
মন্দিরে ভয়াবহ হামলা
ধর্ম

সীতাকুণ্ডে মন্দিরে ভয়াবহ হামলা: প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে উদ্বেগ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর গ্রামে একটি হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সর্বজনীন শ্রীশ্রী

Read More »
Scroll to Top