ভারতের সংসদে পাস হওয়া বিতর্কিত ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫-এর বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলায় ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ এখন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন জেলায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, অগ্নিসংযোগ, প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনার সময়রেখা
৮ এপ্রিল ২০২৫ (মঙ্গলবার)
মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের উমারপুরে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়। শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করে এবং একটি পুলিশ গাড়িতে আগুন দেয়। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে উত্তেজনা আরও বাড়ে।
৯ এপ্রিল ২০২৫ (বুধবার)
সুতি ও সামসেরগঞ্জে বিক্ষোভ তীব্র হয়। পাথর নিক্ষেপে বেশ কয়েকজন পুলিশ আহত হন; দুই ডজনের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশাসন দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ বাহিনী মোতায়েন করে।
১০-১১ এপ্রিল ২০২৫ (বৃহস্পতিবার-শুক্রবার)
মুর্শিদাবাদ ও মালদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। মালদায় ধুলিয়ান গঙ্গা ও নিমতিতা স্টেশনের মধ্যে রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভকারীরা, ফলে বহু ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরা সহিংস জনতার হাত থেকে বাঁচতে একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। মুর্শিদাবাদে এক বাবা ও ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, অভিযোগ রয়েছে যে তারা পুলিশকে তথ্য দিচ্ছিলেন। গাড়ি ও দোকানে আগুন দেওয়া হয়।
১২ এপ্রিল ২০২৫ (শনিবার)
মৃতের সংখ্যা ৩ জনে পৌঁছায়; ১১০ জনের বেশি গ্রেপ্তার হয়। গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মুর্শিদাবাদ ও মালদায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় গুজব রোধে।
ওয়াকফ (সংশোধন) আইন, ২০২৫: কেন প্রতিবাদ?
এই আইনটির বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও কিছু সংখ্যক ধর্মনিরপেক্ষ কর্মীরা তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন, কারণ:
-
স্বায়ত্তশাসনের হ্রাস: ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মুসলিম ধর্মীয় সম্পত্তির স্বাধীন ব্যবস্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
-
‘ব্যবহার দ্বারা ওয়াকফ’ ধারা বাতিল: নতুন ধর্মান্তরিত বা নথিভুক্ত না হওয়া সম্প্রদায়ের পক্ষে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে জমি দান করা কঠিন হয়ে পড়বে।
-
ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা হ্রাস: জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা এখন জেলা প্রশাসকের হাতে, ওয়াকফ বোর্ডের নয়।
-
সীমাবদ্ধতা আইন পুনঃপ্রবর্তন: দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ জমি দখল করে থাকা অমুসলিমদের পক্ষে সেই জমি পুনরুদ্ধারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
মুসলিম নেতারা দাবি করছেন, এই আইন ইসলামিক ধর্মীয় অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত এবং এর ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যাপক হারে হস্তান্তর ঘটবে।
প্রতিবাদকারীরা কারা?
প্রধানত:
-
স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য, যুবক, ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ।
-
মাদ্রাসা ও ইসলামিক কলেজের ছাত্ররা।
-
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড (AIMPLB) ও জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ-এর সমর্থকরা।
-
কিছু বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সমর্থন।
পুলিশের মতে, কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অনুপ্রবেশ করে সহিংসতা উসকে দিয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
তৃণমূল কংগ্রেস (TMC):
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আইনটির বাস্তবায়ন প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “এটি ধর্মীয় বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ।” তিনি আরও বলেন, “এটি বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। বাংলা এমন আইন মানবে না যা আমাদের সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলে। আমরা আমাদের সংখ্যালঘুদের অপমান করতে দেব না।”
ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP):
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “এই সহিংসতা পূর্বপরিকল্পিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিহাদি উপাদানদের বাংলাকে জিম্মি করতে দিয়েছেন। আইন তার নিজস্ব পথে চলবে।”
রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, “এটি প্রতিবাদ নয়, এটি বিশৃঙ্খলা। হিন্দুরা ভয়ে বাস করছে। সরকার ভোটব্যাংকের জন্য চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে উৎসাহিত করছে।” তিনি রাজ্য সরকারকে নিষ্ক্রিয়তার জন্য অভিযুক্ত করেন এবং অভিযোগ করেন যে প্রশাসন “বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি” তৈরি করছে হিন্দুদের হুমকি দিয়ে।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা
-
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (RAF) মোতায়েন করা হয়েছে।
-
১১০ জনের বেশি গ্রেপ্তার, যাদের মধ্যে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে অভিযুক্তরা রয়েছে।
-
মুর্শিদাবাদের পুলিশ কমিশনার বলেন, “আমাদের কর্মকর্তারা উসকানির পরেও সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়েছেন। আমরা সিসিটিভি ও ড্রোন নজরদারির মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করছি।”
-
বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF) স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে।
-
মুর্শিদাবাদ, মালদা ও হুগলির কিছু অংশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত।
প্রাণহানি ও আহত (চলমান)
-
মৃত্যু:
-
সিরাজুল হক (৪৫) ও তার ১৮ বছর বয়সী ছেলে রাকিবুল হক—তাদের একদল লোক সন্দেহভাজন পুলিশ-তথ্যদাতা মনে করে পিটিয়ে হত্যা করে।
-
একজন ১৭ বছরের কিশোর বিক্ষোভকারী মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যায়। যদিও এটি পুলিশ লাঠিচার্জ না কি পাথরের আঘাতে হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
-
-
আহত:
-
অন্তত ১০ জন পুলিশ কর্মী পাথর ছোঁড়ার ফলে আহত হয়েছেন।
-
জঙ্গিপুর, ধুলিয়ান ও বহরমপুরের হাসপাতালে কয়েক ডজন সাধারণ মানুষ ভর্তি রয়েছেন।
-
ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ
-
গাড়ি ও যানবাহন:
-
অন্তত ১৪টি গাড়ি, যার মধ্যে রয়েছে পুলিশের জিপ ও পাবলিক বাস—আগুনে পুড়ে গেছে।
-
-
বাজার ও দোকান:
-
মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ বাজার এলাকায় একাধিক দোকান লুটপাট ও আগুনে ধ্বংস হয়েছে।
-
-
রেলওয়ে সম্পত্তি:
-
মালদা ও ফারাক্কা অঞ্চলে রেললাইন ও স্টেশন অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
-
বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
-
উত্তেজনা এখনও বজায়:
-
পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে।
-
-
সংলাপ শুরু:
-
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম পণ্ডিত, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন পরিস্থিতি শান্ত করতে।
-
-
আইনি পদক্ষেপ:
-
২০০ জনের বেশি অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে FIR দায়ের করা হয়েছে।
-
-
তদন্ত চলছে:
-
পুলিশ খতিয়ে দেখছে সহিংসতা উসকে দিতে কোনো চরমপন্থী সংগঠন বা রাজনৈতিক দুষ্কৃতিকারী ভূমিকা রেখেছে কি না।
-
প্রকাশের তারিখ: ১৩ এপ্রিল, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: Hindustan Times, Times of India,India Today, NDTV, Business Today
Click here to read this article in English