বাংলাদেশের তিনটি জেলার পৃথক তিনটি ঘটনায় প্রতিবন্ধী নারীদের ওপর যৌন সহিংসতার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাগুলো একদিকে যেমন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের উদাহরণ, তেমনি তা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের নিরাপত্তাহীনতার একটি স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে।
রংপুরের পীরগাছা: প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণচেষ্টা, অভিযুক্ত পলাতক
১১ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের নাগদাহ গ্রামে ২৭ বছর বয়সী এক মানসিক ও বাক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় ভ্যানচালক রেজোয়ান আলীর (২২) বিরুদ্ধে। তিনি একই গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে।
ভুক্তভোগীর মা সাংবাদিকদের জানান, তিনি বাড়ির পাশে গোয়ালঘরে কাজ করছিলেন, আর মেয়েটি ঘরে ছিল বৃদ্ধ শাশুড়ির সঙ্গে। সেই সুযোগে প্রতিবেশী রেজোয়ান ঘরে ঢুকে মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। মেয়েটি চিৎকার করলে মা ও আশপাশের লোকজন ঘরে ছুটে যান। অভিযুক্ত ব্যক্তি তখন ঘরের অন্য দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।
ভুক্তভোগীর মা আরও অভিযোগ করেন, রেজোয়ান পূর্বেও তার মেয়ের সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করার চেষ্টা করেছিল এবং এলাকাবাসীর মধ্যে এ বিষয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রযাত্রা প্রতিবন্ধী অধিকার সংস্থার সভাপতি আব্বাস আলী জানান, ভুক্তভোগী তার সংগঠনের সদস্য এবং প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তিনি এ ঘটনাকে ঘৃণ্য উল্লেখ করে বলেন, এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে এ ধরনের অপরাধ বাড়বে।
তবে অভিযুক্ত রেজোয়ান ঘটনার পর থেকে পলাতক থাকায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে পীরগাছা থানার ইনস্পেক্টর (তদন্ত) মো. নাহিদ হাসান বলেন, ভুক্তভোগী থানায় এসেছেন এবং বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
হবিগঞ্জের মাধবপুর: ঘরে ঢুকে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ গ্রেপ্তার
একই দিন, শুক্রবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলায় এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে (৩০) নিজ বাড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে ৬০ বছর বয়সী রুহুল আমীন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে কাশিমনগর পুলিশ ফাঁড়ি। তিনি উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের বীরসিংহপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে।
ভুক্তভোগী তরুণী শারীরিক, মানসিক ও বাক প্রতিবন্ধী। তার মা মাধবপুর থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করেন, ৮ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে মেয়েটির বাবা-মা পাশের কক্ষে অবস্থান করছিলেন। সে সময় অভিযুক্ত রুহুল আমীন ঘরে ঢুকে তরুণীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। মেয়েটির চিৎকারে বাবা-মা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করলেও রুহুল আমীন পালিয়ে যান।
মাধবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, মামলার ভিত্তিতে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ভুক্তভোগী তরুণীকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
পিরোজপুরের নেছারাবাদ: চতুর্থ শ্রেণির প্রতিবন্ধী স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ
পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার ভরতকাঠী গ্রামে এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলছাত্রীকে (১১) ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে মো. অহিদুল ইসলাম (৫৫) নামে এক জেলের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটে ৮ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে।
ভুক্তভোগী শিশুর মা জানান, তার মেয়ে পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সেদিন বিকেলে মেয়েটি নানা বাড়ি যাওয়ার পথে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাকে ফুঁসলিয়ে ঘরে নিয়ে যান এবং ধর্ষণের চেষ্টা করেন। মেয়েটির চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করেন।
পরবর্তীতে শিশুটির মা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বিষয়টি জানালেও কোনো প্রতিকার পাননি। অবশেষে ১১ এপ্রিল তিনি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
গ্রামচৌকিদার সত্য রঞ্জন ব্যাপারী জানান, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছেন এবং থানায় অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “এই পরিবার অত্যন্ত নিরীহ, তারা অনেক অসহায়।”
অভিযুক্ত অহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি এবং তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
নেছারাবাদ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. বনি আমিন জানান, এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং পাটিকেলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির একজন উপ-পরিদর্শক ঘটনাটি তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রতিবন্ধীদের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ
এই তিনটি পৃথক ঘটনায় যে বাস্তবতা উঠে এসেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—বিশেষ করে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া, পুলিশের উদ্যোগ এবং সমাজের অংশগ্রহণ একেক রকম। একই সঙ্গে প্রতিকারের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কতটা অসহায় ও বিচ্ছিন্ন, তা–ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবারগুলো সামাজিক প্রভাব ও দারিদ্র্যের কারণে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে হিমশিম খায়।
এই ঘটনাগুলো দেশজুড়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা ও বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার গুরুত্ব নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
তারিখ: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: deshtv, deshrupantor. kalbela
Click here to read this article in English