কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার হোগলা চাঁপাইগাছি গ্রামে শত বছরের পুরোনো ‘গাজী কালু-চম্পাবতী মেলা’ এ বছর বন্ধ হয়ে গেছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিরোধের কারণে। প্রশাসনিক অনুমতি না পাওয়ায় এবং স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী নেতাকর্মীদের আপত্তির মুখে এই ঐতিহ্যবাহী মেলার আয়োজন বাধাগ্রস্ত হয়। পরে এলাকায় সংঘর্ষ, হামলা এবং দোকানপাটে ভাঙচুরের পর প্রশাসন মেলা বন্ধ করে দেয়।
লোকজ বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের পটভূমি
লোককথা অনুযায়ী, বাদশা শাহ সেকেন্দারের পুত্র শাহ গাজী প্রেমে পড়েন চম্পাবতী নামের এক সামন্ত রাজার কন্যার। গাজীর সঙ্গী হিসেবে কালুর উপস্থিতি এ কাহিনিকে পূর্ণতা দেয়। সময়ের ধারায় গাজী, কালু ও চম্পাবতী স্থানীয় সংস্কৃতিতে কিংবদন্তি চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের নামে প্রতিবছর কুমারখালীর চাঁপাইগাছি গ্রামে আয়োজন করা হয় এই মেলা, যা অঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক ও লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
মেলার সূচনার আগেই বিরোধ
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরের মতো এবারও মেলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সোমবার, অর্থাৎ ১৯ মে থেকে মেলা শুরু হওয়ার কথা ছিল। পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ১৭ মে থেকে দোকান বসানো শুরু হয়। কিন্তু শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামী নেতাকর্মীরা মেলায় ‘অশ্লীলতা’ ও ‘জুয়ার আসর’-এর অভিযোগ তুলে বিরোধিতা করেন। তারা দাবি করেন, এসব কার্যক্রম যুবসমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রশাসনের অবস্থান ও অনুমতির অভাব
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাঁর ভাষায়, “এ নিয়ে পূর্বে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। অনুমতি দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত।”
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলায়মান শেখ বলেন, “মেলার অনুমতি ছিল না। তারপরও মেলার পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি গ্রুপ মাঠে নামে, যার ফলে সংঘর্ষ ঘটে।” তিনি আরও জানান, সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত ১১ জন আহত হন।
সংঘর্ষ ও হামলার বিবরণ
২০ মে সন্ধ্যায় চাঁপাইগাছি বাজার এলাকায় স্থানীয় মুসল্লি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা মেলা বন্ধের দাবিতে উপস্থিত হন। তখন মেলার আয়োজক ও স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা সেখানে অবস্থান নিলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়, ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি হয়, দোকানপাটে হামলা চালানো হয়।
হামলায় জামায়াতের জগন্নাথপুর ইউনিয়ন উলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানসহ অন্তত ছয়জন আহত হন। অপরদিকে, খোকসা সরকারি কলেজের প্রভাষক সরাফাত সুলতান, একাধিক শিক্ষক ও স্থানীয় ব্যক্তি আহত হয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতি
বাজারের একজন কলা ব্যবসায়ী নাদের শেখ বলেন, “শত বছর ধরে এই মেলা হয়ে আসছে। এবারই প্রথম দেখলাম এমন পরিস্থিতি। দোকানপাট লুট হয়ে গেছে, মানুষ আতঙ্কে পালিয়েছে।”
একজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, “জামায়াত-শিবিরের কয়েকশ নেতাকর্মী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। অন্তত ৩০টি দোকানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।”
রাজনৈতিক অবস্থান
মেলার আয়োজকদের দাবি, প্রতিবছরের মতো এবারও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। প্রভাষক সরাফাত সুলতান বলেন, “জামায়াতের লোকজন অতর্কিতে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। প্রশাসনের কাছে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মেলাটি বন্ধ করতে চেয়েছে।”
জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতারা দাবি করেন, “মেলায় অশ্লীল কার্যক্রম ও জুয়ার আসর রয়েছে” এবং “ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেই তারা মেলার বিপক্ষে অবস্থান নেন।”
উপজেলা জামায়াতের আমির আফজাল হোসাইন বলেন, “বিগত বছরগুলোতেও এ মেলায় আপত্তিকর কার্যক্রমের প্রতিবাদ করা হয়েছে। মেলার আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা আর পুনরাবৃত্তি হবে না। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়েছে।”
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও দায় এড়ানো
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এমনকি বার্তা পাঠালেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
থানার ওসি বলেন, “এখনও পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পাইনি। শুনেছি উভয় পক্ষ নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করেছে।”
লোকজ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে ‘গাজী-কালু-চম্পাবতী’ মেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিন্তু এ বছর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরোধ, প্রশাসনিক অনীহা এবং সহিংসতার কারণে মেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘটনাটি স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কৃতি ও সহনশীলতার পরিবেশকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
তারিখ: ২২ মে, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: thedailystar, bdnews24, bd-journal
Click here to read this article in English