মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলায় হরিন্দি গ্রামে একটি পরিবারের সদস্যদের চেতনানাশক প্রয়োগে অচেতন করে দুর্বৃত্তরা একটি ভয়াবহ লুটপাট চালিয়েছে। মঙ্গলবার (২৭ মে) দিবাগত রাতে এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ শ্রীপুর উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি হিমাংশু শিখর রায়ের বসতবাড়িতে। ঘটনায় তার পরিবারের তিন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে বর্তমানে মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. হিমাদ্রী শিখর রায় জানান, তার পিতা হিমাংশু শিখর রায় (৮৫) দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এই অবস্থায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা—হিমাংশুর ছোট ভাই কিশোর কুমার রায় (৭২) ও তার স্ত্রী চন্দনা রায় (৬০)—রাতের বেলা তার পাশে থাকতেন। চিকিৎসাজনিত কারণে রাতে ঘরের বারান্দার গ্রিল খোলা ছিল, যদিও মূল ফটকে তালা লাগানো ছিল।
ড. হিমাদ্রী বলেন, পরিবারের সদস্যরা রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত জেগে ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই সময়ের পরে দুর্বৃত্তরা বাড়ির দেয়াল টপকে বা পূর্ব থেকেই ঘরের ভেতরে লুকিয়ে থেকে চেতনানাশক স্প্রে প্রয়োগ করে সবাইকে অচেতন করে ফেলে। এরপর তারা ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ ও অন্যান্য মূল্যবান মালামাল লুট করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
বুধবার (২৮ মে) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হিমাংশু রায়ের শ্যালক মনোরঞ্জন রায় বাড়িতে গিয়ে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে পাশের একটি দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন তিনি দেখতে পান, বাড়ির প্রতিটি ঘরের মালামাল এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে এবং তিনজন সদস্য—হিমাংশু, কিশোর ও চন্দনা—অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের উদ্ধার করে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. পল্লব কুমার সাহা জানান, রোগীদের অবস্থা স্থিতিশীল হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কিছুটা সময় লাগবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের চেতনানাশক জাতীয় কোনো কিছু খাওয়ানো বা স্প্রে করা হয়েছিল। তবে এটি নিশ্চিত হতে হলে পরীক্ষাগার বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মামুনুর রশিদ বলেন, “তিনজনকে বুধবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে তারা অচেতন অবস্থায় ছিলেন এবং এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন।”
এই ঘটনার বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইদ্রিস আলী গণমাধ্যমকে জানান, “খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। বাড়ির সবাই অচেতন থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। তবে ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।”
অচেতনদের একজন কিশোর কুমার রায়ের মেয়ে অনন্যা রায় জানান, “খবর পেয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখি মা, বাবা ও জেঠু তিনজনই অচেতন। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করি। এদের মধ্যে আমার বাবার অবস্থা সবচেয়ে সংকটাপন্ন ছিল। বর্তমানে তিনজনেরই জ্ঞান ফিরেছে, তবে তারা এখনো কথা বলার অবস্থায় নেই। মা যে গয়নাগুলো পরতেন, সেগুলো নেই। নগদ অর্থসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া গেছে। তবে সম্পূর্ণ তালিকা এখনো জানা যায়নি, পরিবারের সদস্যরা সুস্থ হলে বিস্তারিত জানা যাবে।”
স্থানীয়রা জানান, হিমাংশু শিখর রায় ছিলেন একজন সাবেক প্রধান শিক্ষক এবং হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের শ্রীপুর উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি। এলাকায় তার সুনাম রয়েছে এবং তিনি একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে পরিচিত। এই ঘটনায় এলাকার মানুষদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এই ঘটনার সময় বাড়ির প্রধান ফটক ভিতর থেকে তালাবদ্ধ ছিল, যা এই ঘটনার প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, দুর্বৃত্তরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অথবা ভেতরে পরিচিত কেউ সহযোগিতা করেছে—তবে পুলিশ এখনো এই বিষয়ে নিশ্চিত নয়। তদন্ত সাপেক্ষে ভবিষ্যতে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
এই লুটপাট ও চেতনানাশক প্রয়োগের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা দায়ের হয়নি। পরিবারের সদস্যরা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে তারা আইনগত পদক্ষেপ নেবেন বলে জানা গেছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং দোষীদের শনাক্তে কাজ করছে।
তারিখ: ২৯ মে, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: prothomalo, dhakapost, amarsangbad, kalbela
Click here to read this article in English