নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা বাজার সংলগ্ন একটি সরকারি খাসজমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা দলিত সম্প্রদায়ের পাঁচটি পরিবারের ঘরবাড়ি সম্প্রতি একাধিক দফায় ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিবারগুলোর সদস্যরা বর্তমানে আশ্রয়হীন অবস্থায় রয়েছেন। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই হামলা ও উচ্ছেদের ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিবারগুলোর অভিযোগ: পরিকল্পিত হামলা ও লুটপাট
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার বিশকাকুনি ইউনিয়নের জালশুকা বাজার সংলগ্ন রেললাইনের পাশে সরকারি খাসজমিতে বংশপরম্পরায় দলিত সম্প্রদায়ের পাঁচটি পরিবার বসবাস করছিল। নারী-শিশু মিলিয়ে এই পরিবারগুলোর মোট সদস্যসংখ্যা ২২। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী খলিশাউর ইউনিয়নের ধারা গ্রামের বাসিন্দা সিরাজ মিয়া ও বকুল মিয়া জমিটি তাঁদের ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে দাবি করে পরিবারগুলোকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন।
পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে সুনীল রবিদাস জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের সূত্র ধরে সিরাজ মিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে গত বৃহস্পতিবার সুনীল রবিদাসের বাড়িতে হামলা চালান। অভিযোগ রয়েছে, সেসময় পরিবারের সদস্যদের মারধর করা হয় এবং কোরবানির চামড়া কেনার জন্য ধার করে আনা অর্থ এবং গচ্ছিত কিছু টাকা লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।
দফায় দফায় হামলা: ঘর ভাঙচুর ও উচ্ছেদ
পরিবারগুলোর সদস্যদের ভাষ্যমতে, ঈদের পরদিন পুনরায় হামলা চালানো হয়, যাতে তিনটি ঘর ভাঙচুর করা হয়। এর পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে তৃতীয় দফায় আবারও হামলা চালিয়ে অবশিষ্ট দুটি ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়।
বর্তমানে দলিত সম্প্রদায়ের এই পরিবারগুলোর ২২ জন নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ সকল সদস্যরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
ঘটনাস্থলের চিত্র
ঘটনার পরে জালশুকা বাজার সংলগ্ন রেললাইনের পাশে গিয়ে দেখা যায়—একটুকরো বিধ্বস্ত জমিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া ঘরের মোচড়ানো টিন, ছড়িয়ে থাকা আসবাবপত্র, ভাঙা খাট, বিছানার তোশক ও কাপড়চোপড় মাটির সঙ্গে মিশে আছে। রান্নার হাঁড়িতে থাকা ভাত ও তরকারি ছিটকে পড়ে রয়েছে। জমে থাকা পানিতে ভাসছে গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী।
ঘটনাস্থলে থাকা বৃদ্ধা চম্পা রবিদাস এবং অনীল রবিদাস জানান, তাঁরা বহু বছর ধরে এই স্থানে বসবাস করে আসছেন। তাঁদের ভাষায়, ‘বাবু, এখন আমরা কই যাইয়াম, কই থাকবাম, কই বিচার দিয়াম? আমরার কোনোখানে জায়গা নাই। দুপুরে সেনাবাহিনী আইয়া দেইখ্খা গেছে। ভূমি অফিস থাইক্কা নায়েব সাহেবও আইছিলেন। বলছে, ব্যবস্থা একটা হইব। কিন্তু যারা আমরারে এই অবস্থা করল, তাদের কী বিচার হইব?’
‘আগে কয়েকটা ঘর ভাঙছিল। চামড়া কিননের টেহা-পয়সা লুট কইরা লইয়া গেছিল। আইজ দুপুরে দল বাইন্দা আইয়া বাকি সবার ঘরবাড়ি ভাইঙা গুঁড়াইয়া দিছে। গাছপালও কাইট্টা ফালাইয়া দিয়া গেছে। আর কোনো কিছুই নাই। তারা যা করছে, তা মাইনষের সাথে মাইনষে করে না। আমরা মুচারজাত দেইখ্খা কোনো বিচার পাই না। আমরার কী দোষ, বাবু, আপনিই কইন, আমরার জন্মই কি দোষের? এই ২২ জন মানুষ লইয়া অহন আমরা কই থাকবাম?’
অভিযুক্তের বক্তব্য
অন্যদিকে অভিযুক্ত সিরাজ মিয়া বলেন, জায়গাটি আমাদের। আমার বাবা এই পরিবারগুলোকে থাকতে দিয়েছিলেন। এখন আমাদের নিজস্ব প্রয়োজনে জমিটি লাগবে। কাউকে মারধর করা হয়নি। তবে তাঁদের সরিয়ে দিতে কিছু লোক ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়িঘর ভেঙেছে।
প্রশাসনের অবস্থান
পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজওয়ানা কবির বলেন, খবর পেয়ে আমরা বিশকাকুনি ইউনিয়নের তহশিলদারকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম। তহশিলদার জানিয়েছেন, জমিটি ব্যক্তি মালিকানাধীন নয়, খাস খতিয়ানভুক্ত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, বিষয়টি আমাদের আগে জানা ছিল না। মঙ্গলবার রাতে জানতে পেরে বুধবার সকালে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। পরিবারগুলোর জন্য জরুরি আর্থিক সহায়তা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের পদক্ষেপ
পূর্বধলা থানার ওসি (তদন্ত) মিন্টু দে জানান, ঘরবাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ সত্য। এ নিয়ে ভুক্তভোগী অনীল রবিদাস বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তারিখ: ১২ জুন, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: prothomalo, dailyjanakantha
Click here to read this article in English