টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদ এলাকায় শাকিব খান অভিনীত ‘তাণ্ডব’ সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদুল আজহার দিন থেকে শুরু হওয়া এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর উদ্যোগটিকে স্থানীয় আলেম সমাজ ও ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রতিবাদের মুখে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন আয়োজকরা। আয়োজকদের দাবি, ব্যাপক হুমকি, নিরাপত্তাহীনতা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে কয়েক লাখ টাকার বিনিয়োগসহ সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা হঠাৎই থমকে যায়।
ঈদ উপলক্ষে অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের উদ্যোগ
টাঙ্গাইলে স্থায়ী কোনো সিনেমা হল না থাকায় স্থানীয় দুই সংস্কৃতিকর্মী কামরুজ্জামান সাইফুল এবং সাজু মেহেদী ঈদ উপলক্ষে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন একটি অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে ‘তাণ্ডব’ প্রদর্শনের আয়োজন করেন। অডিটোরিয়ামটি এক মাসের জন্য ভাড়া নিলেও ১০ দিনের অগ্রিম ভাড়া এবং প্রস্তুতিমূলক খরচ মিলিয়ে আয়োজকরা নয় লাখ টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেন। প্রচার, টিকিট ছাপানো, এসি সার্ভিসিং, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগসহ যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধিতা এবং বিক্ষোভ
ঈদের আগের দিন, পারকি ইউনিয়নের মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে মাইকিং করে ‘তাণ্ডব’ প্রদর্শনী বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। পোস্টার ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও ঘটে। এরপর ‘পারকি ইউনিয়ন ওলামা পরিষদ’-এর ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করা হয়, যেখানে সিনেমা প্রদর্শনী বন্ধের দাবি জানানো হয়। আয়োজকদের অভিযোগ, এরপর থেকেই নানা রকমের হুমকি আসতে শুরু করে এবং স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসনিক সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ
আয়োজকরা জানান, তারা ঈদের আগেই থানায় লিখিতভাবে পুলিশি সহায়তা চান। তবে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পুলিশ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি ঈদের ছুটির অজুহাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তারা সহায়তা পাননি। আয়োজক সাইফুল বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছিলাম সবদিক থেকেই বৈধতা নিশ্চিত করতে। কিন্তু বাস্তবিক সহায়তা ছিল অনুপস্থিত।”
নিরাপত্তাহীনতার কারণে শো বন্ধ
ঈদের দিন সন্ধ্যায় মাত্র ২০–২৫ জন দর্শকের উপস্থিতিতে প্রথম শো চালু হলেও পরদিনই স্থানীয় আলেম সমাজ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে সিনেমা বন্ধের আবেদন করে। আয়োজকরা জানান, স্থানীয়ভাবে প্রচারণা চালানো নিষিদ্ধ করা হয়, মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং অডিটোরিয়ামের কর্মীদের অবরুদ্ধ করে রাখার হুমকি দেওয়া হয়।
আয়োজক কামরুজ্জামান সাইফুল তার ব্যক্তিগত বিবৃতিতে জানান, তাকে ‘নাস্তিক’ ও ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত ও আতঙ্কিত করা হয়। একপর্যায়ে তিনি নিজেই ব্যানার খুলে সিনেমা প্রদর্শনী বন্ধ করে দেন এবং রাতের আধারে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
জেলা পরিষদ ও প্রশাসনের অবস্থান
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জানান, গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে অডিটোরিয়াম ভাড়া দেওয়া হয় এবং শর্ত হিসেবে বলা ছিল, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে প্রদর্শনী বন্ধ করতে হবে। কালিহাতী থানার ওসি জাকির হোসেন বলেন, এই বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্বে নেই। ইউএনও খায়রুল ইসলাম ছুটিতে থাকায় তৎপরতা ছিল সীমিত।
সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ নামের একটি সংগঠন এই ঘটনাকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে বিবেচনা করে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তারা এটিকে শুধু একটি সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ নয়, বরং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং শিল্প-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, “একটি সরকারি অনুমোদিত, সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রপ্রাপ্ত সিনেমার প্রদর্শনী সংঘবদ্ধ মবের মাধ্যমে বন্ধ করার ঘটনা সাংবিধানিক ও আইনবিরোধী।”
তারা রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়েছে, সিনেমা হল, কর্মী এবং দর্শকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক এবং যারা এই ঘটনায় আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
তারিখ: ১১ জুন, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: itvbd, banglatribune, samakal, dhakapost, jagonews24, ajkerpatrika, prothomalo
Click here to read this article in English