রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় একটি অস্থায়ী দুর্গা মন্দির উচ্ছেদ এবং সেখানে থাকা প্রতিমা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দেশে এবং বিদেশে উদ্বেগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে পবিত্র রথযাত্রা মহোৎসবের আগের দিন, যখন বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সরকারি জমিতে তৈরি মন্দিরটিকে “অবৈধ স্থাপনা” আখ্যা দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) দুপুরে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বুলডোজার চালিয়ে প্রতিমাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। এই অভিযানের সময় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি এক যৌথ বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে সংগঠন দুটি জানায়, পবিত্র রথযাত্রার আগের দিন মন্দির এবং প্রতিমা ভেঙে ফেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে গভীর আঘাত হেনেছে। তারা আরও বলেন, যদিও রেলের জমি বলে দাবি করা হয়েছে, তবে আশপাশে গড়ে ওঠা অন্যান্য স্থাপনা অক্ষত রয়েছে — বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব ও সাধারণ সম্পাদক ড. তাপস চন্দ্র পাল স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে সাম্প্রতিক সময়ে লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথাও তুলে ধরা হয়। তাঁরা জাতীয় স্বার্থে সরকারের কাছ থেকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, খিলক্ষেত রেলওয়ে এলাকার ওই স্থানটিতে বহু বছর ধরে সার্বজনীন দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে। শুধু দুর্গাপূজা নয়, সেখানে একটি ছোট্ট অস্থায়ী মন্দিরে কালীপূজাসহ অন্যান্য পূজাও নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতো। মন্দিরটির কোনো পাকা স্থাপনা ছিল না, তবে সম্প্রতি এর চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় এবং মূল মন্দির পাকা করার জন্য ইটের গাঁথুনি শুরু হয়।
এরপর সোমবার(২৩ জুন) রাতে একদল মৌলবাদী মন্দিরটিকে “রেলের জায়গায় অবৈধ” বলে দাবি করে সেখানে ভাঙচুর করতে যায়।। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠলে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। ওই রাতে মন্দির কমিটিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্দির সরিয়ে নিতে আল্টিমেটাম দেয় মৌলবাদী দলটি। খিলক্ষেত থানা পুলিশ উভয়পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সমাধানের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার সকালে রেল পুলিশ, খিলক্ষেত থানা পুলিশ সদস্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে বুলডোজার নিয়ে মন্দির উচ্ছেদে আসেন রেলওয়ের দুই কর্মকর্তা।
স্থানীয় যুবক শুভ রায় বলেন, “বাংলাদেশে বহু স্থানে রেলের জমি দখল করে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাস করছে। সেসব স্থানে রেল উচ্ছেদ অভিযান চালায় না। অথচ এখানে কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই আমাদের ছোট্ট মন্দিরটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। এমনকি প্রতিমা সরানোর মতো সময়ও আমাদের দেওয়া হয়নি।”
স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। বুলডোজার দিয়ে মন্দিরের বাইরে ভেঙ্গে ফেলে দেওয়া হয় প্রতিমাগুলি। মন্দির ভাঙার আগে ঘটনাস্থলে প্রচুর পুলিশ ও আর্মি মোতায়েন করা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মহিলাদের সামাল দিতে মহিলা পুলিশও মোতায়েন করা হয়। কয়েকজন মহিলা বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে মন্দির বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। প্রশাসনের লোক সব প্রতিবাদীদের সরিয়ে দিয়েছে।
খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন জানান, “মন্দিরটি রেলের জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। এতদিন তা টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল। সোমবার মন্দির কর্তৃপক্ষ পাকা দেয়াল নির্মাণ শুরু করলে স্থানীয়রা আপত্তি করে, যার ফলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আমরা কয়েকদিন ধরে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ অভিযান চালায়। পুলিশ কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছে।”
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “আমাদের দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে আজকের মধ্যেই উচ্ছেদ করতে হবে। আমরা সেই নির্দেশ অনুযায়ী অভিযান চালিয়েছি। শুধু মন্দির নয়, আশপাশের অনেক দোকান ও অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়েছে।”
এদিকে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ বলেন, “বাংলাদেশ রেলের জমি কেউ দখল করতে পারবে না। আমাদের উচ্ছেদ অভিযান একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা যেখানেই দখল দেখছি, সেখানেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছি।” তবে বুলডোজার দিয়ে প্রতিমা ভাঙার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেন, “অস্থায়ী মন্দিরের কোনো প্রতিমা ভাঙা হয়নি। মন্দির কর্তৃপক্ষ নিজেরাই প্রতিমাগুলো সরিয়ে নিয়েছেন।”
তারিখ: ২৬ জুন, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: mzamin, kalbela
Click here to read this article in English