বরিশাল-ভোলা মহাসড়কের পাশে জঙ্গল থেকে হাত-পা বাঁধা এবং পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধারকৃত নারীর নাম মারিয়া আক্তার (২৩)। তিনি ভোলার ব্যবসায়ী মশিউর রহমানের স্ত্রী এবং বরিশাল নগরীর দপদপিয়া গ্যাসটারবাইন এলাকার বাসিন্দা। রোববার (২৯ জুন) ভোরে বরিশাল সদরের বন্দর থানার তালুকদারহাট এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
উদ্ধার ও চিকিৎসার বিস্তারিত
রোববার ভোরে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানে যাওয়ার পথে সড়কের পাশে জঙ্গলে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় এক অচেতন নারী দেহ দেখতে পান। তারা কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পান যে, নারীটি জীবিত রয়েছেন কিন্তু তার হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে পোড়ার চিহ্ন রয়েছে। পরে বন্দর থানা পুলিশকে খবর দেওয়া হলে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করে।
হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নারীটির শরীরের বেশ কিছু অংশে ঝলসে যাওয়ার মতো পোড়ার ক্ষত রয়েছে। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি এসিড নাকি অন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত।
ঘটনার পেছনের অভিযোগ ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারিয়া আক্তার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তার স্বামী মশিউর রহমান প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাকে এক বছর আগে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রী সোমা আক্তার এবং তার ভাই হাসিবুর রহমান নিয়মিতভাবে তাদের হয়রানি করে আসছিলেন। এর আগে তাদের ভোলায় গেলে প্রাক্তন স্ত্রীর পরিবার তাদের মারধর করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। সেই মামলা এখনও চলমান রয়েছে।
মারিয়া জানান, শনিবার সন্ধ্যায় তিনি বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর কাছে ভোলায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। লাহারহাট ফেরিঘাটে যাওয়ার পর কোনো নৌযান না পেয়ে তিনি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বরিশালে ফিরছিলেন। এই সময় তিন-চারজন ব্যক্তি তাকে ধরে একটি অজানা স্থানে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রী এবং তার ভাইকে তিনি চিনতে পেরেছেন। তাকে সারারাত মারধর করা হয় এবং গর্ভের সন্তান নষ্ট করার উদ্দেশ্যে পেটে আঘাত ও ওষুধ খাওয়ানো হয় বলে তিনি দাবি করেন।
পরদিন ভোরে তাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় তিনি জ্ঞান হারান। স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
পরিবারের বক্তব্য
মারিয়ার মা মনুজা বেগম জানান, তার মেয়ে ভোলায় পৌঁছায়নি শুনে তিনি ছেলেকে নিয়ে ভোরে খোঁজ করতে বের হন। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে পুলিশ থেকে কল পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করেন। মারিয়া তাকে জানায় যে, তার ওপর হামলা চালানো হয়েছে এবং গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিবার।
মারিয়ার ভাই জানান, তারা খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে বোনকে পেয়েছেন এবং এখনো ঘটনার বিস্তারিত জানেন না।
মারিয়ার স্বামী মশিউর রহমান বলেন, ‘উজিরপুরে প্রথম বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পারিবারিকভাবে তালাক দিই। এর এক বছর পর মারিয়াকে বিয়ে করি। বিয়ের পর থেকে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী সোমা আক্তার এবং ভাই হাসিবুর রহমানসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে আমাকে হয়রানি করছেন। এ নিয়ে মামলা করেছেন তারা। বিয়ের পর মারিয়াকে নিয়ে আমার বাড়িতে গেলে আমাদের মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলমান। এরই মধ্যে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর শুনে তারা আরও ক্ষুব্ধ হন। শনিবার মারিয়াকে ভোলায় আসার জন্য বলি। মারিয়া অসুস্থ থাকায় প্রথমে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে মারিয়া তার মাকে নিয়ে রওনা হয়। তাকে লাহারহাট ফেরিঘাটে পৌঁছে দিয়ে তার মা নগরের বাসায় ফিরে যান। রবিবার ভোরে আমার শাশুড়িকে জানাই মারিয়া তো বাসায় আসেনি। এরপর শুরু হয় সন্ধান। কারণ শনিবার বিকাল থেকে মারিয়ার মোবাইল নম্বর বন্ধ ছিল।’
প্রশাসনের বক্তব্য
বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দেলোয়ার হোসেন জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। তার হাত-পায়ে ফোসকার মতো চিহ্ন রয়েছে, যা দাহ্য পদার্থ ছুড়ে মারার কারণে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ক্ষত গুরুতর নয়। তিনি আরও বলেন, এখনও কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
থানার এসআই সিরাজুল ইসলাম জানান, নারীটির চোখ-মুখও বাঁধা ছিল এবং শরীরের তিন স্থানে ফোসকার চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাকে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান জানান, বর্তমানে রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল এবং তার চিকিৎসা চলছে। পুলিশ তাকে ওসিসি ইউনিটে ভর্তি করেছে।
তারিখ: ৩০ জুন, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: banglatribune, dailyjanakantha, kalerkantho, bd-pratidin, ittefaq, prothomalo, samakal
Click here to read this article in English