চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষক পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে গত ৪ জুলাই ২০২৫ (শুক্রবার) একটি নজিরবিহীন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে উপাচার্য ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ শিক্ষার্থী, যাঁরা দাবি করেন—একজন শিক্ষক গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হওয়ার অভিযোগ ঘিরেই মূলত এই বিক্ষোভের সূত্রপাত।
ঘটনাপ্রবাহ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির বোর্ড বসার কথা ছিল ৪ জুলাই ২০২৫ (শুক্রবার) বিকেল ৩টায়, উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে। কিন্তু এর আগেই, দুপুর আড়াইটার দিকে একাধিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয় এবং পরে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। ফলে উপাচার্য ড. মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন এবং পদোন্নতি বোর্ডের সদস্যরা ভবনের ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরীর ওপর হামলার মামলার ২০তম আসামি। এছাড়াও, তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগও আনা হয়।
তবে অভিযুক্ত শিক্ষক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর দাবি, তিনি কোনো মামলার আসামি নন এবং বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, “আমি ঢাকায় চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছিলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ছুটি নিয়েছিলাম। মামলার বাদীকেও আমি চিনি না।”
ঘটনার সময় একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তীকে উত্তেজিত পরিস্থিতির মধ্যে কথা বলার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছি। আমাকে একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। আমি শান্তিপূর্ণভাবে জবাব দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে বাধা দেওয়া হয়।”
ভবনে উত্তেজনা ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির জন্য উপাচার্যের কক্ষে বোর্ড সভা শুরু হলে, আন্দোলনকারীদের একাংশ সেখানে উপস্থিত হন এবং সভার বিরোধিতা করেন। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও কক্ষজুড়ে হট্টগোলের মধ্যে শিক্ষক কুশল বরণ কথা বলতে চাইলে তাঁকে থামিয়ে দেন উপ-উপাচার্যরা।
আন্দোলনকারীরা তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন, যেখানে তাঁকে “ফ্যাসিবাদের দোসর”, “র-এর এজেন্ট”, “ইসকনের সদস্য” প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের একাংশ বলেন, ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরীর উপর হামলার মামলায় কুশল বরণ চক্রবর্তী ২০তম আসামি হিসেবে উল্লেখ রয়েছেন। মামলাটি দায়ের হয় ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর।
প্রায় দুই ঘণ্টা চলমান বিক্ষোভের পর বিকেল ৫টার দিকে প্রশাসন জানায়, ড. কুশল বরণের পদোন্নতি বোর্ড স্থগিত করা হয়েছে। এরপর শিক্ষার্থীরা তালা খুলে দেয় এবং বিক্ষোভ শেষ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “সংবাদমাধ্যমে কিছু সংবেদনশীল তথ্য এবং শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বোর্ড স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি ২৪ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার জন্য তোলা হবে।”
অতীত বিতর্ক
একইসঙ্গে, পূর্বের আরেকটি বিতর্কিত ঘটনার প্রসঙ্গও সামনে আনা হয়। ২০২৪ সালের ২৬ অক্টোবর, কুশল বরণ চক্রবর্তী ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা’ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড”, “বিদেশি চক্রান্ত” ও “বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন” করার অভিযোগ তোলা হয়।
তবে ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী দাবি করেন, এসব উদ্যোগ গবেষণা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজের অংশ ছিল। তিনি বলেন, “আমি কোনো সংগঠনের সদস্য নই, বরং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করি—সেটিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।”
শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী ছাত্র শিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ প্রমুখ। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পাশাপাশি আরও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছে। তাদের দাবি:
ড. কুশল বরণ ও অন্যান্য বিতর্কিত শিক্ষকদের একাডেমিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। ৫ আগস্টের মধ্যে যেসব শিক্ষক-কর্মচারী জুলাইয়ের আন্দোলন দমন বা বিরোধিতায় যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী পরিবেশ’ নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক সমাজ ও প্রশাসনিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন
ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, শিক্ষকের মর্যাদা, এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে। কোনো অভিযোগের সঠিক তদন্ত ও প্রক্রিয়া ছাড়া একজন শিক্ষকের পদোন্নতি প্রক্রিয়া এভাবে জনরোষ ও মব চাপের মুখে স্থগিত হওয়া এক উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত।
ড. কুশল বরণ বলেন, “৫০ জন মানুষ মিলে চিৎকার করলেই কি একজন শিক্ষকের ক্যারিয়ার থেমে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কি এখন সত্য যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত নেবে?” তিনি আরও বলেন, “যারা আমাকে ইসকনের সদস্য, রাষ্ট্রবিরোধী বা এজেন্ট বলছে, তারা যদি আমার কার্যক্রম খতিয়ে দেখে, তাহলে সত্য বেরিয়ে আসবে।”
পরবর্তী পদক্ষেপ ও প্রশাসনের আশ্বাস
শিক্ষকদের একটি অংশ মনে করেন, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো শিক্ষককে পদোন্নতি প্রক্রিয়া থেকে এভাবে বাদ দেওয়া উচিত নয়। তাঁদের মতে, শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক, তবে বিচারহীন জনচাপ প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি আলোচনায় তোলা হবে।
তারিখ: ০৪ জুলাই, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: manobkantha, thedailystar, bdnews24, banglanews24, sarabangla, dhakapost, bd-pratidin, somoynews, kalerkantho
Click here to read this article in English