October 31, 2025 3:47 am

শতাব্দী ভব এর ছোটগল্প : যশোর রোড ২০৩১

যশোর রোড ২০৩১

যশোর রোড ২০৩১

 

মাইনষ্যে নাকি দুধকলা দিয়ে কালসাপ পোষে আর বাউল ফজর আলী পোষে কালো ময়না। এক মুরিদ গান শুনে ময়নাডা ফজর আলীকে উপহার দিয়েছিলো বছর তিন আগে, সেই থেকে ফজরের শরীরের একটা অঙ্গের মতো হয়ে গেছে পাখিটা। কিন্তু ময়না নিয়ে ফজরের দুঃখের শেষ নাই। নিজের চেয়েও বেশি যত্ন করে ফজর পাখিটাকে, তার একটাই আশা পাখিটা তাকে একদিন বাবা ডাকবে।

ফজরের সংসারে কোন পোলাপান নাই। ডাক্তার, কবিরাজ কোন কিছুতেই কোন কাম হয় নাই। অগত্যা পাখির মুখেই বাবা ডাক শুনতে ফজর ব্যাকুল। ফজরের বউ অবশ্য বলছে, অনেক বাচ্চা যেমন দেরিতে কথা কয়, তোমার এই ময়নাও হয়তো তাই। কিন্তু বাবাতো দূরের কথা ময়না কোন শব্দও করে না। ফজর আলী সেই ফজর থেকে রাত অব্দি ময়নার সাথে একটা কথাই বলে, ‘ময়না, বাবা কও, বাবা কও’।


যশোরের সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে ফজরের ভিটা। আশেপাশে বেশিরভাগই হিন্দু। তাতে অবশ্য ফজরের কোন সমস্যা নাই। হিন্দুদের উৎসব-পার্বনেই ফজরের গানের কদর বেশি। কিন্তু কে জানতো স্বাধীনতার ৬০ বৎসর পার হইতে না হইতেই দেশ নয়া পাকিস্তান হইবো। দেশ এহন জেহাদিদের হাতে। ক্ষমতায় আইসা ওদের প্রথম কাজই হইলো হিন্দু খেদানো। যদিও স্বাধীনতার পর থেকেই এসব কমবেশি চলতাছিলো কিন্তু এহনকার পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। জেহদীদের দুই নম্বর টার্গেট কবি, শিল্পী, নায়ক, নায়িকা এরা। তবে ফজরের অতো চিন্তার কিছু নাই। সে নামাজ-রোজা ঠিকঠাক না করলেও আল্লারসুলে বিশ্বাস করে। আর গায়েন হইলেও সে প্রত্যন্ত গ্রামের বাউল। সমস্যা হইলে হইবো ঢাকার নামি-দামি শিল্পীদের। তার কী আসে যায়। কয়দিন হইলো গ্রামের অবস্থা খারাপ। যেনো আবার একাত্তর নাইমা আইছে।

হিন্দু বাড়িগুলান রাতারাতি শ্বশান হইয়া গেছে। যুবকদের বেশিরভাগই মারা পরছে, জেহাদিদের হাতে। মাইয়ারা বয়স যাই হোক পাইকারি ধর্ষণ হইতাছে। শিশুরা পর্যন্ত বাদ যাইতাছে না।

ফজরের বউ কয়েকবার কইছে, চলেন ভারত চইলা যাই। ফজর খেকানি দিয়া কইছে, ক্যান? মালোয়ানগো দেশে যাইতে তোর এতো হাউশ ক্যান? আমি কি হিন্দু না নাস্তিক যে ডরাইতে হইবো। কিন্তু ফজর আলী জানতো না, নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। এক ভোরে ফজরের আজানের সময় জিহাদী সরকারের জিহাদি লোকজন ফজরের বাড়িতে হানা দেয়। দোতরা-হারমোনিয়াম আগুনে পোঁড়াইয়া ফজরের চুল দাঁড়ি কাইটা নেয়। ফজর কোনমতে তওবা কইরা প্রাণভিক্ষা পায়। ভিটামাটি লিখে নিয়ে ওরা ফজর ও তার বউকে মুক্তি দেয়। এক রাতের মধ্যে পথের ফকির হয়ে ফজর পথে নামে। সাথে বউ আর সন্তান (ময়না পাখি)।

যশোর রোড ২০৩১


তিন দিন অনাহারে ফজর আলী পথে পথে ঘুরে ক্লান্ত বিপর্যস্ত। বর্ডারে অনেক অনেক মানুষ, সবারই গন্তব্য ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া সরকার কী একটা জরুরি পাশ চালু করছে। ওই পাশ ছাড়া বর্ডার পেরোনো অসম্ভব। পাসপোর্ট ভিসা এখন অচল। অবশ্য সচল হইলেও কোন লাভ নাই ফজরের। সে এখন পথের ফকির। যে কারণে দালাল ও চোরাকারবারিরাও সাহায্য করবে না। পথের ধারে অসুস্থ হয়ে পরে রইলো ফজরের বউ। প্রায় অচেতন। ফজরও কতোক্ষণ চোখ মেলে রাখতে পারবে বলা মুশকিল। এমন সময় জীর্নশীর্ন এক তরুণ এগিয়ে এলো ফজরের দিকে। চেহারায় শহুরে ছাপ স্পস্ট। চোখে সহানুভূতি নিয়ে জানতে চাইলো খবারাখবর। ফজর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। কোন কিছুই না লুকিয়ে সবিস্তারে বর্ণানা করলো।

আগন্তুক জানালো সে একজন কবি। জিহাদী সরকার তাকে পেলেই কতল করবে। কোনমতে একটা পাশ নিয়ে ছুটছে কাঁটাতার পেরোনোর আশায়। ফজরকে বসিয়ে রেখে সে দোকান থেকে পাউরুটি, পানি নিয়ে এলো। সেই ছোকরা নিজে পাখিটাকে খাওয়ালো। ফজরের অনেকটা তন্দ্রার মতো এসে যাচ্ছিলো। সেই তন্দ্রাতেই জেগে উঠলো ফজরের ভেতরের এক দানব। সে নিশ্চিত এই ছোকরা নাস্তিক আর নাস্তিক কোতল মানে নিশ্চিত বেহেস্ত। সেই সাথে পেয়ে যাচ্ছে আপাতত বাঁচার শেষ আশা ভারতের পাশ। ফজর নিজেই অবাক হয়ে গেলো ধর্মকর্ম এতোদিন ঠিকঠাক না মানলেও কী করে তার মনে ঈমানী জোশ জেগে উঠছে। সিদ্ধান্ত নিতে সে এক সেকেন্ড সময় নিলো মাত্র।

ছোকরা তখন ময়না পাখিকে পানি খাওয়াচ্ছিলো। ফজর আস্তে করে পিছন থেকে তার গলার গামছাটা ছোকরার গলায় প্যাঁচিয়ে ধরলো। এই গামছাটা তার ওস্তাদ তাকে এক গানের আসরে পরিয়ে দিয়েছিলো। ময়না পাখিটা নির্বাক তাকিয়ে আছে, ফজরের বউ তখনো অচেতন। দূরে এশার আযান ভেসে আসছে। মৃত্যুর আগে চোখ বড় বড় হয়ে উঠা তরুণ কবির মাথায় একটা লাইন-ই ঘুরছিলো, ‘ঘুমিয়ে আছে জিহাদীরা সব মুসলিমের অন্তরে’।


ফজর নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না, এতো সহজে তার বিপদ কেটে যাবে। বর্ডার পেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। ভোর হতে চললো। যদিও সীমান্তের এপারে এখন পরিবেশ দিনের মতো। মানুষের কমতি নেই। এতো মানুষ কোথা হতে আসে ফজর ভেবে পায় না। একাত্তরে এই যশোর রোড যেনো ৬০ বছর অতীতে ফিরে গেছে। যেনো সময়টা ২০৩১ নয় ১৯৭১। ফজরের বউ জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। এখন অনেকটাই সুস্থ। রাস্তার ধারে বসে লুচি আর তরকা খাচ্ছে। ফজর কিছু কুল কিনে এনেছে। সেই ছোকরার পকেট থেকে যথেস্ট পয়সা পাওয়া গেছে। টাকা, রুপি এবং ডলারও ছিলো কিছু। আরো কিছু বৈদেশের মূদ্রা। রুবল না কী যেনো লেখা ওগুলোর গায়।

ফজর এখন তার সন্তান (ময়না পাখি) কে কুল খাওয়াচ্ছে। হঠাৎ ফজরকে চমকে দিয়ে ময়না প্রথমবার কথা বলে উঠলো, বাবা, বাআআবা। ফজরে বউ খাওয়া থামিয়ে হাততালি দিয়ে উঠলো। ফজর অবাক চোখে চেয়ে রইলো পাখিটার দিকে। পরমুহূর্তে পা দিয়ে পিষে ধরলো চোট্ট পাখিটা৷ গলা। ছটফট করতে করতে ময়না পাখিটা মারা গেলো। ফজরের বউ সে রাতে দ্বিতীয় বারের মতো জ্ঞান হারালো। অনেক দূর থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে….

ছোটগল্প : যশোর রোড ২০৩১

লেখক : শতাব্দী ভব

লেখক ও প্রকাশক

তারিখ : ০৮ জুলাই, ২০২৫

Click here to read this article in English

[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

পাথর দিয়ে নির্মম হত্যা স্বর্ণময়ীর মৃত্যু
মতামত

“ভচকানো” বাংলার প্রতিশোধ: স্বর্ণময়ীর মৃত্যু নয়, এক কর্মসংস্কৃতির চপেটাঘাত

“যার ব্রে’স্টের শেপ এরকম ভচকানো, তার বাংলাটা ভচকানো হবে।” এই এক বাক্যই যথেষ্ট বুঝিয়ে দেয়, কেমন বিষাক্ত মানসিকতা লুকিয়ে থাকে

Read More »
শৈলকুপায় প্রতিমা ভাঙচুর Idol Vandalism in Shailkupa
ধর্ম

শৈলকুপায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় প্রশ্ন, ষড়যন্ত্র নাকি মানসিক অসুস্থতা?

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায় আসন্ন দুর্গাপূজাকে ঘিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভোররাতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত

Read More »
হিন্দু নিশ্চিহ্নের ইহুদিদের ভাগ্য ইসলামের সাথে কমিউনিজমের দুর্গোৎসবে
মতামত

বিকাশ মজুমদারের কলামঃ ইসলামের সাথে কমিউনিজমের অবৈধ সম্পর্ক

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বাম রাজনীতি করা লোকজন সাধারণত নিরীশ্বরবাদী হয়ে থাকেন। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে বাম রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে ইসলামের

Read More »
নবী মুহাম্মদ–কে কটূক্তি Prophet Muhammad Insult
ধর্ম

নবী মুহাম্মদ–কে কটূক্তির অভিযোগে প্রবাসীর বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, পরে মামলা

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় বেলজিয়ামপ্রবাসী এক যুবকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলাম ধর্ম ও নবী মুহাম্মদ –কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠার

Read More »
বানিশান্তা যৌনপল্লি Banisanta Brothel at Risk
নারী

নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার শঙ্কায় বানিশান্তা যৌনপল্লি

বিশেষ প্রতিবেদন: তীব্র নদীভাঙন, বারংবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের শিকার হয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছেন বানিশান্তার শতাধিক পরিবার। অসংখ্যবার বাসস্থান

Read More »
Scroll to Top