রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামের সাঁওতালপাড়া ছয় দিন ধরে প্রায় জনমানবশূন্য। গত ৩০ জুলাই বুধবার দুপুর ও সন্ধ্যায় দুই দফা হামলার পর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১২টি পরিবারের মধ্যে ১১টি পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে। কেবল এক বৃদ্ধা অচল অবস্থায় রয়ে গেছেন একটি বাড়িতে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙচুর করা বাড়িঘরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে জিনিসপত্র, কোথাও পচে যাওয়া খাবার, কোথাও বিছানায় মশারি টাঙানো অবস্থায় পড়ে আছে কুকুর।
পটভূমি ও বসবাসের ইতিহাস
প্রায় পাঁচ বছর আগে বারনই নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের(পাউবো) বাঁধের ওপর স্থানীয় তিনজন কাউন্সিলরের অনুমতিতে সাতটি সাঁওতাল, চারটি ধাঙ্গড় (ওরাঁও) এবং একটি রবিদাস সম্প্রদায়ের পরিবার বসতি স্থাপন করে। বাঁধের ঠিক পরেই রয়েছে স্থানীয় বিএনপি কর্মী মো. বাবলুর জমি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলো তাঁর জমির সামনে বসবাস শুরু করায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যদিও জমি সরকারি (পাউবো) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঘটনার সূচনা
স্থানীয়দের বর্ণনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন সকালে বাবলুর সঙ্গে সাঁওতালপাড়ার বাসিন্দাদের কথা–কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। অভিযোগ রয়েছে, বাবলু পাড়ার এক নারীকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করলে নিষেধ করতে গেলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে পাড়ার কয়েকজন যুবক বাবলুকে আঘাত করে। বাবলুর স্ত্রী ডলি বেগমের দাবি, সেদিন সকালে কিছু বাসিন্দা বাড়ির সামনে দেশি মদ পান করছিলেন এবং বাবলু তাঁদের এভাবে প্রকাশ্যে মদ না খাওয়ার জন্য বললে এক নারী তাঁর শার্টের কলার ধরেন ও তাঁকে মারধর করা হয়।
দুই দফা হামলা
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, প্রথম হামলা হয় দুপুরে, দ্বিতীয় হামলা সন্ধ্যার আগমুহূর্তে। সাঁওতালপাড়ার সর্দার শ্যামল মুর্মুর অভিযোগ, প্রথম হামলায় বাবলু ও তাঁর লোকজন হরি মুর্মু, তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে মারধর করে। পুলিশ এসে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলে কিছুক্ষণ পরই দ্বিতীয় হামলা হয়। হামলাকারীদের হাতে হাঁসুয়া, বল্লম ও ছোরা ছিল বলে অভিযোগ করেন শ্যামল। তাঁর দাবি, ওই আক্রমণের পর সবাই আতঙ্কে পালিয়ে যায়, কেউ বাড়ি থেকে কোনো কিছু নিয়ে যেতে পারেনি। নগদ টাকা, গৃহপালিত কবুতর ও অন্যান্য সামগ্রী লুট হয়েছে বলে অভিযোগ।
ফাঁকা বাড়ির চিত্র
হামলার ছয় দিন পর সোমবার সকালে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুরের চিহ্ন বহন করছে। কোথাও দরজা তালাবদ্ধ, কোথাও খোলা কিন্তু বাসিন্দাশূন্য। কিছু বাড়িতে বিছানায় মশারি টাঙানো, মেঝেতে পচে যাওয়া ভাত, রান্নাঘরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আলু ও পেঁয়াজ দেখা গেছে। একটি বাড়ির ভেতরে দুটি কুকুর শুয়ে থাকতে দেখা যায়। কেবল হিমেন রবিদাসের বাড়িতে তাঁর শাশুড়ি অমলা দাসীকে পাওয়া যায়। নওগাঁর নিয়ামতপুর থেকে চিকিৎসার জন্য ১৫ দিন আগে এখানে আসা অমলা দাসী হাঁটতে পারেন না বলে সরে যাননি।
অভিযুক্ত পক্ষের বক্তব্য
বাবলুর স্ত্রী ডলি বেগম বলেন, তাঁদের জমির সামনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলো অত্যাচার করে ও জমির ফসল হতে দেয় না। তিনি দাবি করেন, মদ খেতে নিষেধ করায় তাঁর স্বামীকে মারধর করা হয়, পরে তাঁর স্বামী লোকজন নিয়ে গেলেও কাউকে মারেনি এবং বাসিন্দারা নিজেরাই ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভাঙচুরের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরাই নিজের বাড়ি নিজেরা ভেঙেছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ
পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ জানান, সাঁওতালদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পবা থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, উভয়পক্ষই থানায় অভিযোগ দিয়েছে। আহতদের চিকিৎসা সহায়তা ও মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো মামলা দায়ের করা হয়নি। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে, সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বর্তমান অবস্থা
বাগসারার সাঁওতালপাড়া এখনো আতঙ্কে নিস্তব্ধ। ১২টি বাড়ির মধ্যে ১১টি বাড়ি ফাঁকা, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে ভাঙচুর ও লুটপাটের চিহ্ন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দারা ভয়ে ফিরতে পারছেন না। অভিযুক্ত পক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করলেও, ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি—হামলার ফলে তাঁরা জীবিকা, সম্পদ ও আশ্রয় হারিয়েছেন। প্রশাসনিক তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ এলাকায় স্বাভাবিকতা ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তারিখ: ০৫ আগস্ট, ২০২৫
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন: prothomalo, jugantor, ajkerpatrika, ittefaq
Click here to read this article in English