October 24, 2025 1:00 pm

নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার শঙ্কায় বানিশান্তা যৌনপল্লি

বানিশান্তা যৌনপল্লি Banisanta Brothel at Risk

বিশেষ প্রতিবেদন: তীব্র নদীভাঙন, বারংবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের শিকার হয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছেন বানিশান্তার শতাধিক পরিবার। অসংখ্যবার বাসস্থান স্থানান্তর করে নদী থেকে পেছনের দিকে সরে এলেও, আর কোনো উপায় নেই পরিবারগুলোর হাতে। বর্তমানে পশুর নদীর পাড়ে নির্মিত ভাঙা বাঁধেই আশ্রয় নিয়েছেন তারা। তবে চতুর্দিক থেকে ঘিরে আছে পানি। বলা যায় পানির উপর ভাসছে পরিবারগুলোর শতাধিক বাসস্থান। ফলে যেকোন সময় একটি বড় ঢেউ কিংবা প্রকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে চিরতরে বিলীন হবার চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন পাড়ার ৩৫০ জন বাসিন্দা।

মোংলা বন্দরের যাত্রাশুরুর সাথে সাথে ১৯৫৪ সালের দিকে জন্ম হয় বানিশান্তা যৌনপল্লির। এক সময় দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি হিসেবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু একাধিক দুর্যোগ আর নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে এ পাড়ার বাসিন্দা এবং যৌনকর্মীর সংখ্যা।

 

সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় বানিশান্তা যৌনপল্লির শতভাগ বাসস্থান। পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পেলেও, ধার-দেনা করে কোনভাবে পুনরায় বাসস্থান স্থাপন করেছে পরিবারগুলো। কিন্তু একের পর এক বিপদ কিছুতেই স্বস্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না পল্লির বাসিন্দাদের।

সভানেত্রী-রাজিয়া-বেগম-রানী
সভানেত্রী-রাজিয়া-বেগম-রানী

বানিশান্তা যৌনপল্লির সভানেত্রী রাজিয়া বেগম রানী ১৯৮৬ সাল থেকে এই পাড়ায় বসবাস করছেন। তিনি জানান, একাধিকবার প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে তারা এখন সর্বশান্ত। নিয়তির বিধান মেনে নিয়ে নদীগর্ভে বিলিন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।

সভানেত্রী আরো জানান, এই পল্লীতে ১১৫ জন যৌনকর্মী বসবাস করেন। তবে পুরুষ, প্রবীণ এবং শিশুদের নিয়ে সর্বমোট বাসিন্দার সংখ্যা ৩৫০ জন। বাসিন্দাদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিগত সরকারের সময় তিনি দিনরাত দৌড়ঝাপ মন্ত্রণালয় থেকে নদীর পাড়ে ব্লক স্থাপনের প্রজেক্ট পাশ করান। কিন্তু স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য প্রজেক্টটিকে স্থানান্তর করে নিজের এলাকায় নিয়ে যান। এমন ঘটনার পর মনোবল হারিয়ে ফেলেন পল্লীর বাসিন্দারা।

সভানেত্রী রাজিয়া বেগমের মতে, দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষয়ক্ষতি যদি ঠেকানো যেতো, পতিতাবৃত্তি ছেড়ে এখানকার যৌনকর্মীরা অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারতো। কিন্তু বারংবার বাসস্থান স্থানান্তর ও পুননির্মাণ করতে গিয়ে প্রায় সকল যৌনকর্মী ২ থেকে ৩ লাখ টাকার লোনের খপ্পরে পড়েছেন। লোনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ইচ্ছা না থাকলেও অনেকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছেন।

২০১৩ সালে পশুর নদীর পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চায়না কোম্পানির মাধ্যমে বেড়িবাঁধ দেয়া হয় কিন্ত এটি ২০১৭ সালের দিকে ভাঙ্গন শুরু হলে পুনরায় সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ২০১৮ সালের জুনের দিকে বেড়িবাঁধটি ভেঙ্গে প্রায় কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে যায় আর পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ৫ সহস্রাধিক বাসিন্দা।

পাড়ায় প্রায় ৫০ শিশুর বসবাস। যাদের অনেকেই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। সভানেত্রী রাজিয়া বেগম শিশুদের পড়াশুনার তাগিদে ডিসির কাছে স্কুল ও শেল্টার হোমের জন্য আবেদন করেন। তিনি জানান, “আবেদনটি পাশ হলে, মন্ত্রণালয় থেকে সচিব এসে স্কুল ও শেল্টার হোমের উদ্বোধনও করা হয়। কিন্তু স্থানীয় মেম্বার ও সংসদ সদস্যকে দাওয়াত না দেওয়ায় প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।”

বানিশান্তার যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় কাজ করছে পিএসটিসি নামের একটি এনজিও। নিয়মিত যৌনকর্মীদের এইচআইভি টেস্টসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে সংস্থাটি। এছাড়া, স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্রাথমিক চিকিৎসা, কনডম ও জরুরি ঔষধ নিশ্চিত করছে পিএসটিসি।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে বানিশান্তার যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় কাজে নিয়োজিত আছেন ডা. ডলি সরকার। তিনি জানান, কিছুদিন আগেই আমরা সকল যৌনকর্মীর এইচআইভি চেকআপ করেছিলাম। রেজাল্ট ‘জিরো’। এছাড়া এখানের শতভাগ যৌনকর্মী কনডম ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে অভ্যস্ত।

ডা. ডলি সরকার আরো জানান, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই পাড়ায় একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেউ অসুস্থ বোধ করলে কিংবা স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ নিতে এখানে আসেন।

সভানেত্রী রাজিয়া বেগম রানী জানান, আগে-পরে যতো সরকার ক্ষমতায় ছিলো তারা যথেষ্ঠ সহযোগিতা করেছে। বর্তমানেও সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছি। এছাড়া এনজিওগুলো আমাদের পাশে আছে। শুধু একটি সমস্যাই আমাদের স্বাস্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না। আমাদের পুরো পাড়া নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। যেকোন রাতে পাড় ভেঙে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।

সভানেত্রীর দাবি, ব্লকের একটি বাঁধই পারে বানিশান্তা যৌনপল্লির শতাধিক পরিবারের ঘর, জীবন এবং অস্তিত্বকে রক্ষা করতে। ব্লক বসানো হলে প্রতিবছর দুই থেকে তিন বার বাসস্থান স্থানান্তরের খরচ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। এতে করে, অনেক যৌনকর্মী সমাজে সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত হতে পারবে।

খুলনা পানি উন্নয়ন বিভাগ-২ নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম জানান, এমন পরিস্থিতির বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো কি করা যায়।

একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবা, অন্যদিকে সমাজের রক্তচক্ষু, এই দুইয়ের মাঝে যেন বন্দি পশুর নদীর তীরে মংলা বন্দরের কোল ঘেষে গড়ে ওঠা বানিশান্তা যৌনপল্লির শেকড়ছেঁড়া, বাস্তুহীন নারীদের জীবন। নদীভাঙনের ফলে সৃষ্ট সংকটের দ্রুত সমাধান করা না গেলে, চিরতরে ইতিহাসের অংশে পরিণত হতে পারে বানিশান্তা যৌনপল্লির নাম।

তারিখ: ১৯ আগস্ট, ২০২৫

Click here to read this article in English

আরো খবর পড়ুন

পাথর দিয়ে নির্মম হত্যা স্বর্ণময়ীর মৃত্যু
মতামত

“ভচকানো” বাংলার প্রতিশোধ: স্বর্ণময়ীর মৃত্যু নয়, এক কর্মসংস্কৃতির চপেটাঘাত

“যার ব্রে’স্টের শেপ এরকম ভচকানো, তার বাংলাটা ভচকানো হবে।” এই এক বাক্যই যথেষ্ট বুঝিয়ে দেয়, কেমন বিষাক্ত মানসিকতা লুকিয়ে থাকে

Read More »
শৈলকুপায় প্রতিমা ভাঙচুর Idol Vandalism in Shailkupa
ধর্ম

শৈলকুপায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় প্রশ্ন, ষড়যন্ত্র নাকি মানসিক অসুস্থতা?

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায় আসন্ন দুর্গাপূজাকে ঘিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভোররাতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত

Read More »
হিন্দু নিশ্চিহ্নের ইহুদিদের ভাগ্য ইসলামের সাথে কমিউনিজমের দুর্গোৎসবে
মতামত

বিকাশ মজুমদারের কলামঃ ইসলামের সাথে কমিউনিজমের অবৈধ সম্পর্ক

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বাম রাজনীতি করা লোকজন সাধারণত নিরীশ্বরবাদী হয়ে থাকেন। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে বাম রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে ইসলামের

Read More »
নবী মুহাম্মদ–কে কটূক্তি Prophet Muhammad Insult
ধর্ম

নবী মুহাম্মদ–কে কটূক্তির অভিযোগে প্রবাসীর বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, পরে মামলা

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় বেলজিয়ামপ্রবাসী এক যুবকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলাম ধর্ম ও নবী মুহাম্মদ –কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠার

Read More »
সীতাকুণ্ডে আসাদ নূরের
ধর্ম

সীতাকুণ্ডে আসাদ নূরকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোয় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে যুবক থানায়

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ব্লগার ও অধিকারকর্মী আসাদ নূর – এর জন্মদিন উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট শেয়ারকে কেন্দ্র করে এক হিন্দু

Read More »
Scroll to Top