হিন্দুরা কাঠ, বাঁশ, খড়, মাটি দিয়ে যে সাকার দেবদেবীর কাঠামো বানায় তাকে বলে প্রতিমা। আসলে তারা তো প্রতিমা পুজো করে না, বরং প্রতিমার ভিতরে দেবত্ব আরোপ করে তার পুজো করে। এ প্রসঙ্গে সুন্দর একটা কথা আছে এরকম—-
“পুতুল পুজো করে না হিন্দু কাঠ, মাটি দিয়ে গড়া,
মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে হয়ে যায় আত্মহারা”।
ফিলোসফিটা হলো দেবদেবীর স্বরূপ কল্পনা করে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। দেখবেন যেদিন প্রতিমার চোখ আঁকা হয় তখন দেউড়ি মণ্ডপকে একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। আবার পুরোহিত যখন দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন তখনও মণ্ডপ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। (কাকে বলছি এসব কথা? যারা শুধু ঘৃণা ছাড়া কিছু বোঝে না!) । তারা এসব মর্ম কথা কেমনে বুঝবে? যেখানে পারিবারিকভাবে ঘৃণার চর্চা হয় সেখানে অন্যেকে কীভাবে সম্মান দেখাবে?
ঘৃণা চর্চার ক্ষেত্রে শুয়োরের বাচ্চা ডঃ মহম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে কুকুরের বাচ্চা ফরহাদ মাজহার বা গুয়ের পোকা সলিমুল্লাহ খান অথবা বাম্প্রদায়িক বদরুদ্দিন উমর সবাই সমান অংশীদার। হিন্দু বিদ্বেষ ও বিতাড়নে ভেদ নেই আমলীগ, জামাত, বিয়েনপি, বামপন্থী আরও যত সুশীল।
বাংলাদেশে দুর্গাপুজো এলেই এই যে মূর্তি ভাঙা উৎসব শুরু হয় তার পেছনে ওয়াজি ওহাবি হুজুরদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জঙ্গি ফরহাদ মাজহারেরও বিশাল ভূমিকা আছে। সে কয়েক বছর ধরে ন্যারেটিভ তৈরি করেছে কীভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর হিন্দুরা উল্লাস করে দুর্গাপুজো করেছিল। তার আগে নাকি এভাবে উৎসবের মত দুর্গাপুজোই হতো না।
ভক্তি শ্রদ্ধা লাগবে না শুধু একটু বোধ আর পরমতে সহিষ্ণুতা থাকলেই হবে (পরমতে সহিষ্ণুতা মুসলমানদের কাছে ঘোড়ার ডিমের মত)। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র যখন চণ্ডী পড়েন, “কুবের দিলেন রত্নহার, হিমালয় সিংহবাহন, পিণাকপাণি দিলেন ত্রিশুল” তখন একজন বিশ্বাসী হিন্দু মানস চোখে সত্যিই দেখতে পান আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি।
প্রকৃতির অন্তরাকাশে যখন জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগ্নমাতার আগমন বার্তা তখন আমাদের মুসলিম সমাজ জেগে উঠে হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙার জন্য। বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে (ইদানিং পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হয়েছে) শরৎকালে হিন্দুদের দুর্গাপুজোর পাশাপাশি মুসলিমদের মূর্তি ভাঙাও একটা উৎসব। আগে আমি মজা করে বলতাম, হিন্দুদের দুই সেট প্রতিমা বানানো উচিত। একসেট হিন্দুদের পুজোর জন্য আরেক সেট তৌহিদি জনতার ভাঙাভাঙির জন্য। এতে করে হিন্দুদের যেমন পুজোর পুন্য অর্জন হলো আবার মুসলিমদের মূর্তি ভাঙার সোয়াবও হলো। আর এভাবেই দুর্গাপুজো হতে পারে বাংলাদেশের সর্বজনীন উৎসব।
মূর্তি ভাঙাভাঙির মহামারির প্রথমদিকে গণমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন থেকে বলত “কিছু দুর্বৃত্ত মন্দিরে ভাঙচুর করেছে, কিন্তু দুর্বৃত্তরা কারা সে সম্পর্কে সবাই জানলেও শুধু পুলিশ কিছু জানতো না”। তারপরে এতদিন প্রতিমা ভাঙচুর হলেই প্রশাসন থেকে নিজ উদ্যোগেই বলতে ভাঙচুরকারী মানসিক ভারসাম্যহীন। (আমিও তাই বলি, একজন পরিপূর্ণ ইসলামপালনকারী কখনো মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে না)। এবারে প্রশাসন থেকে বলছে বাতাসের কারণে নাকি প্রতিমা ভেঙে গেছে। গাজীপুরের মণ্ডপে ভাঙচুরের পরে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার বলেছেন, “কিছু লোক ছেলেমানুষী করে ফেলেছে”। এই লোকদের কথা শুনে মনে হয় বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতির কোন মূল্য নাই, তাদেরকে যেকোনো ভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যায়।
গতকাল ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপায় একটি মণ্ডপের দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর করেছে তৌহিদি জনতা। তবে এই ভাঙচুরের মধ্যে একটা ডাইমেশন যুক্ত হয়েছে। সেটা হলো ভাঙচুরকারী আমার খুব কাছের একজনের পরিচিত। তারা নাকি ছোটবেলা থেকেও একে অপরকে চেনে এবং তাকে কখনো মূর্তি ভাঙার মত উগ্র বলে মনে হয় নি। এখানেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা কেন একজন সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মুসলিমের মনে হিন্দুদের মূর্তি ভাঙার ইচ্ছা জেগে উঠল?
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, মূর্তি ভাঙাতে কিন্তু সরল বিশ্বাসের মুসলিম ভাইয়ের কোন দোষ নেই, কারণ মূর্তি ভাঙা ইসলামের ধর্মীয় নির্দেশ। মুসলিমদের জাতির পিতা ইব্রাহিম মূর্তি ভেঙেছিলেন, মুসলমিদের নবী হযরত মহম্মদ মূর্তি ভেঙেছিলেন। সুতরাং মূর্তি ভাঙা মুসলমানদের লিগাসি।
এখন কথা হচ্ছে মূর্তি ভাঙার লিগাসি ওয়ালা মুসলমানদের সাথে মূর্তি পূজারি হিন্দুদের সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব? শুধু হিন্দু না, যেকোন ধর্ম বিশ্বাসই ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক তাই আমি মনে করি বাংলাদেশের হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা আলাদা ভূখণ্ড দরকার তা নাহলে বাংলাদেশের অবশিষ্ট হিন্দুরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
লেখকঃ বিকাশ মজুমদার
মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মী
নিউইয়র্ক, ইউএসএ
তারিখ: ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]





