“যার ব্রে’স্টের শেপ এরকম ভচকানো, তার বাংলাটা ভচকানো হবে।” এই এক বাক্যই যথেষ্ট বুঝিয়ে দেয়, কেমন বিষাক্ত মানসিকতা লুকিয়ে থাকে কিছু শিক্ষিত পুরুষের ভেতরে। এই এক বাক্যই বোঝায়, কতটা অসুস্থ, বিকৃত, এবং ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠে কিছু মানুষ যখন তাদের হাতে থাকে অফিসের চেয়ার, পদের প্রভাব আর নিঃশব্দে সহ্য করতে বাধ্য মেয়েরা।
স্বর্ণময়ী বিশ্বাস, ২৬ বছর বয়সী এক তরুণী, নিজের প্রতিভা আর স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে গলায় ফাঁস দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। মৃত্যুর আগে তিনি ছিলেন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা স্ট্রিম-এর গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তার জীবন শেষ হয়েছে, কিন্তু শেষ হয়নি সেই “বিষাক্ত সংস্কৃতি”, যেটির অংশ হয়ে উঠেছিল তার কর্মক্ষেত্র।
বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতির মুখপাত্র: আলতাফ শাহনেওয়াজ ওরফে নয়ন। যার মুখে “ভচকানো ব্রেস্ট” দিয়ে নারীর ভাষা বিচার করা হয়, সেই আলতাফ শাহনেওয়াজ ছিলেন ওই সংবাদমাধ্যমটির বাংলা বিভাগের প্রধান। একজন সম্পাদক, একসময়কার সাহিত্য সম্পাদক, এবং বর্তমানের এক মানসিক ধর্ষক।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে — শুধু কটুক্তি নয়, বরং ধারাবাহিকভাবে শব্দের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন। তিনি একজন নারী সহকর্মীর পেশাগত দক্ষতাকে বিচার করেছেন তার শরীরের আকৃতি দিয়ে। এটি কোনো “হাস্যরস” নয়, এটি একটি মানসিক ধর্ষণ, যা শারীরিক স্পর্শ ছাড়াও এক নারীর আত্মসম্মানকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
তার সহকর্মী, সাংবাদিক মৌসুমী আচার্য্য — যিনি স্বর্ণময়ীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, স্পষ্ট করে বলেছেন, “ওর সাড়ে সাত মাসের বেশিরভাগ দুঃখ, হতাশা, এবং বিরক্তির কারণই ওই ভদ্রলোক।” স্বর্ণময়ীর অভিযোগ ছিল নিয়মিত: “উনি সবসময় আক্রমণ করেন, এমন ভাষা কেন ব্যবহার করেন?” অর্থাৎ এটি একবারের ঘটনা নয়, এটি ছিল নিয়মিত প্যাটার্ন। এবং সবচেয়ে ভয়ংকর — অফিসের সবাই জানত। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি।
অফিস জানত, অফিস চুপ ছিল। বাংলা স্ট্রিম অফিসে এই বিষাক্ত আচরণ কোনো গোপন রহস্য ছিল না। সহকর্মীরা জানত, সম্পাদক জানতেন। কিন্তু অভিযুক্তকে শাস্তি নয়, বরং পুনর্বহাল করা হয়।
অর্থাৎ, একজন নারী কর্মী লিখিত অভিযোগ করলেন আর অফিস তার উপরেই নীরবতা চাপিয়ে দিল।
এই নীরবতা আসলে অপরাধীর ঢাল হয়ে দাঁড়াল।
একজন তরুণী যখন দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন বুঝতে হবে, সে দুর্বল নয়, বরং একটি অমানবিক দেয়ালের সামনে আটকে গেছে, যেখানে অভিযোগ মানে চাকরি হারানো, মানে “বাজে মেয়ে” তকমা পাওয়া।
আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশের শ্রম আইন ও হাইকোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী,
প্রত্যেক কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে? অধিকাংশ অফিসেই এসব কমিটি হয় কাগজে-কলমে, নয়তো আদৌ নেই।
আইন অনুযায়ী, মৌখিক, অঙ্গভঙ্গি, বা শাব্দিকভাবে কোনো নারীকে যৌনভাবে অপমান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা (Penal Code) অনুযায়ী, নারীকে “অশোভন মন্তব্য বা ইঙ্গিত” করার দায়ে কারাদণ্ড হতে পারে। অর্থাৎ, আলতাফ শাহনেওয়াজের মন্তব্য (“ব্রেস্টের শেপ…”) একদম স্পষ্টভাবে এই ধারার আওতায় পড়ে।
কিন্তু কি হবে?
প্রতিষ্ঠান চুপ, সমাজ চুপ, আর একজন তরুণীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
এই সমাজে মেয়েরা কতটা ‘সেফ’? এই প্রশ্ন নতুন নয়, কিন্তু প্রতিটি স্বর্ণময়ী আমাদের সামনে এনে দেয় এক নতুন আয়না। যেখানে একজন নারীকে দেখা হয় তার শরীরের মাপে, পোশাকের রঙে, হাসির ফ্রিকোয়েন্সিতে।
যেখানে ‘শিক্ষিত পুরুষ’ মানে অনেক সময় ‘পরিশীলিত শিকারি’। যেখানে ক্ষমতাধর পুরুষের একটি বাজে বাক্য অফিসের ভেতর নরমালাইজ হয়ে যায়, আর একজন নারী প্রতিদিন তার আত্মসম্মানের একটু একটু করে মৃত্যু বয়ে বেড়ায়।
স্বর্ণময়ী বেঁচে থাকলে আজ কী করতেন? সম্ভবত তিনি বলতেন “আমি বিচার চাই না, আমি সম্মান চাই।” কিন্তু এখন আমাদের দায়িত্ব, তার মৃত্যুকে নীরবতায় চাপা না দেওয়া। আমাদের চিৎকার করে বলা উচিত:
“এই সমাজে তোমার ক্ষমতার জোরে কাউকে অপমান করার অধিকার নেই।
তুমি সম্পাদক নও, তুমি অপমানের স্থপতি।
তোমার শিক্ষা, তোমার পদ, তোমার পরিচয়, সবই মিথ্যা,
কারণ তুমি একজন শিক্ষিত ধর্ষক।”
শেষ কথা: এই মৃত্যু যেন ‘নিউজ’ না হয়। স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু একটি শিরোনাম নয়, এটি একটি আয়না।
যেখানে প্রতিটি কর্মক্ষেত্র, প্রতিটি সম্পাদক, প্রতিটি সহকর্মী নিজেদের মুখ দেখতে পারবে।
এবং যারা আজও বলে – “আলতাফ দায়ী নয়, এটা ওর ব্যক্তিগত সমস্যা,”
তাদের জন্য একটাই উত্তর: “যে সমাজ যৌন নিপীড়নকে ‘মতবিনিময়’ বলে মানে নেয়, সেই সমাজই ধীরে ধীরে মেয়েদের মেরে ফেলে।”
লেখক : শারমিন জাহান অর্পি
আর্টিস্ট
তারিখঃ ১৯ অক্টোবর ২০২৫
[মাইনোরিটিওয়াচে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]




